পিলখানায় দুপুরে অবস্থান চিহ্নিত করে রাতে হত্যা

‘২৩ মার্চ রাতেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলাম পিলখানায়। ২৫ তারিখ দুপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ২২ বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি পিলখানা ঘুরে ঘুরে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা কে কোথায় আছেন সেটি দেখে নেয়। সন্ধ্যার পর আমরা বুঝতে পারি যে রাতে কিছু একটা হচ্ছে। রাত ১২টার পর প্রথমে কয়েকটি গুলির শব্দ। এরপর শুরু হলো নির্বিচারে হত্যা। আমরা অনেকেই পালিয়ে বের হলাম কাঁটাতার পেরিয়ে। কিন্তু অনেককে বন্দী করা হলো। তাঁদের নির্যাতন করে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন জায়গায় হত্যা করা হয়েছে।’
২৫ মার্চ রাতের স্মৃতিচারণা করে কথাগুলো প্রথম আলোকে বললেন মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম।
১৯৭১ সালে পিলখানায় গোয়েন্দা শাখায় চাকরি করতেন নায়েক রেজাউল করিম। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৫ মার্চ সকাল থেকেই ইপিআরের প্রতিটি গেটে বালুর বস্তা দিয়ে অস্ত্র নিয়ে কড়া পাহারা দিচ্ছিল বালুচ রেজিমেন্টের সদস্যরা। তারা বেশির ভাগ বাঙালির অস্ত্র নিয়ে নিয়েছিল। ফলে রাত ১২টায় যখন পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালাল, বেশিক্ষণ প্রতিরোধ হয়নি। অনেকেই সেদিন মারা গেছেন। অনেকেই বন্দী হয়েছেন।’
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামক যে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে, তার তিনটি লক্ষ্যস্থলের একটি ছিল পিলখানায় ইপিআর সদর দপ্তর। উদ্দেশ্য ছিল সেখানে মোতায়েন পাঁচ হাজার ইপিআর জওয়ানকে নিরস্ত্র করা এবং ওয়্যারলেস এক্সচেঞ্জ দখল করা।
ওই সময় ঢাকার বিডিআরের সেক্টর কমান্ডারের নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন শাহজাহান মিয়া। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাত ১২টার পরপরই ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। আমরা যে যেভাবে পেরেছি আত্মরক্ষার্থে বেরিয়ে গেছি। আমি আমার হাতের রাইফেলটি নিয়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছিলাম। আমরা সেদিন ৪০০-৫০০ জন বের হতে পেরেছিলাম। কিন্তু শত শত ইপিআর সদস্য বের হতে পারেননি। তাঁদের সেদিন হত্যা করা হয়। অন্যদের মোহাম্মদুপর শারীরিক কেন্দ্রে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।’
বন্দী ইপিআর জওয়ানদের নিয়ে ২৯ মার্চ সকাল আটটায় ইপিআর ময়দানে সভা করেন সেই সময়ের ইপিআরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার নেসার আহমদ। এ সময় তিনি বন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে চলে যান। কিন্তু পরে সবাইকে বন্দী করে মোহাম্মদপুরের শরীরচর্চা কেন্দ্রে নিয়ে শুরু হয় নির্যাতন। সেখানে সুবেদার মেজর শওকত আলী, নায়েব সুবেদার শামসুল হক, নায়েক মহিউদ্দিনসহ আরও অনেক ইপিআর সদস্যকে হত্যা করা হয়। সুবেদার মেজর শওকত আলী ইপিআর থেকে টেলিগ্রাফিক মেসেজের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করেছিলেন।
মেজর শওকতের মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যাপক সেলিনা পারভীন তখন উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী ছিলেন। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পিলখানা থেকে আব্বার পাঠানো এই বার্তাটি চট্টগ্রামের একটি বিদেশি জাহাজে ধরা পড়ে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীও জেনে যায়। তারা খুঁজতে থাকে পিলখানা থেকে কে সেটি পাঠাচ্ছেন। ইপিআরের ওয়্যারলেস তখন বন্ধ ছিল। আব্বা বাসায় সব ব্যবস্থা করে সেখান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠাচ্ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনী সেটি খুঁজে রাতেই বাসা থেকে আব্বাকে নিয়ে যায়।’
পিলখানার বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিলের দায়িত্বে থাকা ইপিআর সদস্যদেরও ২৫ মার্চ রাতে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। এ ছাড়া পিলখানা, প্রেসিডেন্ট হাউসসহ (অতিথি ভবন সুগন্ধা) বিভিন্ন জায়গা থেকে শতাধিক নিরস্ত্র ইপিআর সদস্যকে ধরে এনে রমনার কালীবাড়িতে হত্যা করা হয়। ২৫ মার্চ রাত ১২টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ডিআইটি ভবনের ওপর থেকে গভর্নর হাউসে (বঙ্গভবন) অবস্থানরত ইপিআর সস্যদের ওপর গোলাবর্ষণ করে। পরে সকালে বালুচ রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সেনা সেখানে ঢুকে ইপিআরদের নিরস্ত্র করে। এখানে ইপিআরের কয়েকজন সদস্য নিহত হন।
অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইপিআরের (বর্তমান বিজিবি) নিহত ৮১৭ জন সদস্যের নাম-পরিচয় পাওয়া গেলেও ২৫ মার্চের প্রথম প্রহরে ইপিআরের ঠিক কতজন সদস্যকে পিলখানায় হত্যা করা হয়েছিল, সেই তথ্য সুনির্দিষ্টভাবে এখনো জানা যায়নি। এই সংখ্যা শতাধিক হবে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর গ্রন্থের সম্পাদক ও বিজিবির বর্তমান মেজর নূরুল আমিন হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ইপিআরের ৮১৭ জন শহীদ হন। এর মধ্যে ২৫ মার্চ রাতেই পিলখানায় অনেককে হত্যা করা হয়। তবে সংখ্যাটা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কারণ অনেককে ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে এখানে-সেখানে লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছে।’