নিবন্ধন রক্ষায় নির্বাচনে আসতে বাধ্য বিএনপি

দলের নিবন্ধন রক্ষার জন্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিতে বাধ্য হবে বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। দলটি মনে করে, পরবর্তী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব হারাবে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে আসবে বলে তাঁরা মনে করছেন, তাই তাদের দাবি মানা না-মানা নিয়ে কোনো আলোচনার দরকার নেই।
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামও প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপিকে নিজের প্রয়োজনেই নির্বাচনে আসতে হবে। দলের নিবন্ধন রক্ষা করতে হবে। তবে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে আওয়ামী লীগ কোনো ছাড় দেবে না।
দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) আইনের ৯০ এইচ (১) (ই) ধারা বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হবে। তাঁদের মত, এই ধারার কারণে বিএনপি নির্বাচনে আসতে বাধ্য হবে। আরপিও ৯০ এইচ (১) ধারায় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি কারণে কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। এই ধারার (ই) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হবে, যদি কোনো রাজনৈতিক দল পরপর দুটি সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়।
অবশ্য নিবন্ধন বাতিলের ক্ষেত্রে কোনো দল যদি ৯০ এইচ (১) (ই) ধারা লঙ্ঘন করে, সে ক্ষেত্রে দলটির নিবন্ধন সরাসরি বাতিল হবে না। পরপর দুবার নির্বাচনে অংশ না নেওয়া দলটিকে শুনানিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেবে। কমিশনের কাছে দলটির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলেই কেবল তারা নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেবে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো দল যদি একাধিক নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী যা হওয়ার তা হবে।
সরকার আগ বাড়িয়ে কোনো বিষয়ে উদ্যোগী হবে না।’ তবে তিনি বলেন, বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। ভবিষ্যতে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে এর মাশুল তাদের দিতে হবে। ব্যাখ্যা দিয়ে ভুল সংশোধন হয় না।
আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন থাকবে না—আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন বক্তব্যের জবাবে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, নিবন্ধন হারানোর যে ভয় দেখানো হচ্ছে, সেই ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না।
এই আইন প্রণয়নের সময় সেই সময়ের শামসুল হুদা কমিশন সব রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়েছিল। আইন প্রণয়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ওই সময় কমিশনের ধারাবাহিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সংলাপের তথ্য নিয়ে কমিশন একটি বই প্রকাশ করে। সেখানে বিএনপির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে কমিশনের আলোচনায় দেখা গেছে যে নিবন্ধন বাতিলের এই ধারা নিয়ে দলটির পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি তোলা হয়নি। অন্য দলগুলোর পক্ষ থেকেও এই ধারা মেনে নেওয়া হয়েছিল। তবে ওই আলোচনায় কমিশনকে প্রার্থিতা বাতিলের দেওয়া ক্ষমতা নিয়ে আপত্তি তোলে বিএনপিসহ কয়েকটি দল। পরে এ-সংক্রান্ত ৯১ (ই) ধারাটি বাতিল করে ২০০৮-এর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শামসুল হুদা কমিশনের নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পরপর দুবার কোনো রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে দলটির নিবন্ধন বাতিলের ঝুঁকি থেকে যায়। তিনি বলেন, আইনে এটা বলা আছে। তবে এ ব্যাপারে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। কেননা, নিবন্ধন বাতিল হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কমিশনের।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কোনো দল যদি নিজেই নিজেকে বিলুপ্ত করে বা সরকার কোনো দলকে নিষিদ্ধ করলে সরাসরি কমিশন ওই দলের নিবন্ধন বাতিল করবে। কিন্তু নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে বাতিলের প্রয়োজন হলে কমিশনকে অবশ্যই দলটির কথা ও নির্বাচনে না যাওয়ার যুক্তি শুনতে হবে।
যে কারণে নিবন্ধন থাকা জরুরি
বিএনপি ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও ওই সময় থেকে যত স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার সবগুলোতে অংশ নিয়েছে। দলের তৃণমূলের নেতাদের চাঙা এবং দলকে সক্রিয় রাখতে তারা নির্বাচনে অংশ নেয় বলে নেতারা জানিয়েছেন। কিন্তু সম্প্রতি সরকার কেবল জেলা পরিষদ নির্বাচন ছাড়া সব নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে করতে আইন করেছে। এ অবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে এবং নিবন্ধন বাতিল হলে বিএনপি ধানের শীষ প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে না। ফলে নির্বাচনের মাঠে দল ও দলের প্রতীক গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে, এমন ঝুঁকি নিয়ে বোকার মতো নির্বাচনে বিএনপি না আসার সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমার মনে হয় না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির মতো একটা দলের নিবন্ধন বাতিল করাটা এত সহজ নয়। তা ছাড়া, আগামী নির্বাচনে সরকারকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের দাবি মানতে বাধ্য করে বিএনপি নির্বাচনে যাবে।
অবশ্য বিএনপির সহসভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন আর স্থানীয় নির্বাচন এক নয়। নিবন্ধন বাতিল হলে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হতে পারে না।