ভোটারবিহীন কেন্দ্র, কারচুপির অভিযোগ

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল খুব কম। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় শহরের সাউথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র থেকে ছবিটি তোলা l প্রথম আলো
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল খুব কম। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় শহরের সাউথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র থেকে ছবিটি তোলা l প্রথম আলো

পাবনার সুজানগর ও ঈশ্বরদী এবং নাটোরের বড়াইগ্রামে গতকাল সোমবার উপজেলা পরিষদের উপনির্বাচন অনেকটা সাদামাটাভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। ভোট নিয়ে ভোটারদের মধে৵ দেখা যায়নি তেমন কোনো উত্তেজনা। তবে ঈশ্বরদীতে ভোট কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। আমাদের আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবাদ:

পাবনার সুজানগর উপজেলায় ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল নগণ্য। মাঠে ছিল না প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও ছিল না ভোট নিয়ে তেমন উত্তেজনা। তাই ভোটার উপস্থিতি কম হলেও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শেষ হয়েছে নির্বাচন। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল কাদের বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন।

নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম ভোট গণনা শেষে সন্ধ্যা সাতটায় ফলাফল ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী আবদুল কাদের পেয়েছেন ৮৬ হাজার ৪৭৩ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি হাজারী জাকির হোসেন পেয়েছেন ৫ হাজার ৮৬৩ ভোট।

গত বছরের অক্টোবরে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। এরপর চেয়ারম্যান পদে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগ থেকে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল কাদের। বিএনপির প্রার্থী ছিলেন উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজারী জাকির হোসেন।

নির্বাচনে প্রচারণা শুরুর পর থেকেই মাঠে বিএনপির উপস্থিতি চোখে পড়েনি। অভিযোগ ছিল, সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের চাপে বিএনপির লোকজন মাঠে নামতে পারছেন না। নির্বাচনী জনসংযোগ করতে গেলে হামলা ও মারপিটের শিকার হচ্ছেন তাঁরা। তবে বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার করেছে আওয়ামী লীগ। এই পক্ষের দাবি, জনবিচ্ছিন্নতার কারণে বিএনপি ভোটারদের কাছে যেতে পারছে না।

স্থানীয় ব্যক্তিদের দাবি, দুই দলের পাল্টাপাল্টি এই অবস্থানের কারণে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ হারিয়েছেন সাধারণ ভোটাররা। তাঁরা ভোট দিতে আসেননি।

গতকাল নির্বাচনী এলাকা ঘুরেও ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্র চোখে পড়ে। সকাল সাড়ে ৯টায় উপজেলা সদরের মডেল পাইলট উচ্চবিদ্যালয়, বেলা ১১টায় মালিফা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুপুর ১২টায় ভবানীপুর দাখিল মাদ্রাসা ও বেলা ১টায় আহম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ভোটার নেই। এরই এক ফাঁকে বেলা সাড়ে ১১টায় মালিফা ভোটকেন্দ্রের পাশে বিএনপির সাবেক সাংসদ ও কেন্দ্রীয় বিএনপির কর্যনির্বাহী সদস্য সেলিম রেজা হাবিবের বাড়িতে এবং দুপুর সাড়ে ১২টায় বিএনপির প্রার্থী হাজারী জাকির হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দুজনকেই নেতা-কর্মীদের নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়।

বিএনপির প্রার্থী জাকির হোসেন অভিযোগ করেন, সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের দাপটে তাঁরা মাঠে টিকতে পারেননি। তাঁর দলের সাবেক সাংসদও মারপিটের শিকার হয়েছেন। তাই তিনি ভোট থেকে না সরে মাঠ থেকে সরে আসেন।

তবে অভিযোগ আমলে না নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওহাব বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীরা বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কোনো অশোভন আচরণ করেনি। কিন্তু দীর্ঘদিন জনগণ থেকে দূরে থাকায় তারা কারও কাছে ভোট চাইতে পারেনি। এখন পরাজয়ের গ্লানি মুছতে অভিযোগ করছে।’

বিকেলে স্থানীয় বাজারের একটি চায়ের দোকানে বসা এক ভোটার বলছিলেন, ‘সুজানগরে যে ভোট হলো টেরই পালেম না। মনে হলো ফাঁকা মাঠে গোল হচ্ছে।’

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, শান্তিপূর্ণ ও সুন্দর পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

এদিকে ঈশ্বরদীর উপনির্বাচনে ভোট কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি গতকাল বেলা ২টায় ঈশ্বরদী সাঁড়া মাড়োয়ারী স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র ঘুরে দেখার সময় সাংবাদিকদের কাছে এই অভিযোগ করেন।

এই উপজেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মাহমুদা বেগম ২৩ হাজার ১০৪ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিদ্রোহী জান্নাতুল ফেরদৌস পেয়েছেন ১ হাজার ৬৫ ভোট। ঈশ্বরদীর ইউএনও শাকিল মাহমুদ গতকাল রাত ৮টায় এ খবর নিশ্চিত করেছেন।

জান্নাতুল ফেরদৌস অভিযোগ করেন, উপজেলার কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে তাঁর সমর্থকদের ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে। মুলাডুলি ইউনিয়নের নিকরহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নারিচা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ ভোটকেন্দ্রের ভেতর থেকে তাঁর পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মাহমুদা খাতুনকে দায়ী করেন। তিনি আরও বলেন, বিষয়টি পুলিশ সুপার (এসপি), ঈশ্বরদীর ইউএনও, ওসি ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে মৌখিকভাবে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি।

তবে প্রার্থী মাহমুদা বেগম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী নির্বাচনে কারচুপি বা জাল ভোট দেওয়ার সঙ্গে জড়িত নন। এটা সাজানো অভিযোগ।

নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারীকে বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল হোসেন এই ফলাফল ঘোষণা করেন।

সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী ভোট পেয়েছেন ৬৬ হাজার ৪৫৫টি। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী রাশেদুল ইসলাম পেয়েছেন ৩৯ হাজার ২০৬ ভোট।

এই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদের উপনির্বাচনে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল অস্বাভাবিক কম। ভোটকেন্দ্রগুলো ঘুরে ফাঁকা কেন্দ্র চোখে পড়ে। গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিটে উপজেলার কামারদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২ নম্বর বুথে একটি, ১ নম্বর বুথে ১১টি, ৩ নম্বর বুথে ৫৫টি ও ৪ নম্ব বুথে ৩৪টি ভোট পড়েছে। বিএনপির প্রার্থীর প্রতিনিধি আবু তালেব বলেন, ‘ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসার আগ্রহ কম।’

বেলা ১১টা ২৩ মিনিট। আগ্রাণ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ২ হাজার ৬৬২ জন ভোটারের মধ্যে ততক্ষণে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৫৩৫ জন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রতিনিধি (পোলিং এজেন্ট) আবদুল মান্নান বলেন, তাঁর প্রার্থীর মনোনয়ন নিয়ে দলে বিরোধ রয়েছে। তাই দলীয় নেতা-কর্মীরাই ভোট দিতে আসেননি।

বেলা ১টা ২ মিনিট। চামটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২ হাজার ৩১৫ জন ভোটারের মধ্যে তখন পর্যন্ত ভোট দিয়েছেন ৯৭০ জন। বিএনপির প্রতিনিধি মোছা. আজেদা বলেন, এই কেন্দ্রে তাঁদের প্রতিনিধিদের প্রতিপক্ষরা প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছে। তাই সবাই চলে গেছেন। তিনিই শুধু টিকে আছেন। তবে নৌকার প্রতিনিধি জুলিয়ানা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আসলে ধানের শীষের প্রতিনিধিরা কেন্দ্রেই আসেননি।

বেলা ৩টা ৪০ মিনিট। নটাবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আব্বাছ উদ্দিন বলেন, ভোট শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে। তবে ভোট দিতে অনেকেই আসেননি।

ভোটার উপস্থিতি অস্বাভাবিক কম হওয়া সম্পর্কে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল কাদের বলেন, উপজেলার চামটা, দিঘর, কচুগাড়ী, ভিটা, মাড়িয়া সরকারি বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে প্রতিপক্ষের বাধার মুখে সমর্থকেরা ভোট দিতে যেতে পারেননি বলে শুনেছেন। এ কারণেও উপস্থিতি কম হতে পারে।

তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে কিছু নেতা-কর্মী ও সমর্থকের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। কিন্তু কেউই দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করেননি। ভোটার উপস্থিতির সরকারি হিসাব পাওয়া গেলে তাঁরা বিষয়টি পর্যালোচনা করে মূল্যায়ন করতে পারবেন।