মামলার জট, বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি

২০০৯ সালের ১৫ নভেম্বর খুলনা নগরের খালিশপুরে বাস্তুহারা কলোনি এলাকার স্কুলছাত্রী আফসানা মিমিকে (১৩) গণধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যার ঘটনা ঘটে। ১৬ নভেম্বর দুপুরে বাস্তুহারা এলাকার একটি মাদ্রাসার পুকুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় মিমির বাবা ইমাম হাওলাদারের করা মামলাটি বর্তমানে খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। কিন্তু সাত বছরেও মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে মামলা চলতে থাকায় আসামিপক্ষের লোকজন মিমির পরিবারকে হুমকি ও সমঝোতার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তাঁদের ভয়ে পরিবারটি এলাকা ছেড়েছে। সব সময় আতঙ্কে থাকে পরিবারটি।

২০০৮ সালের ঘটনা। যৌতুক না পেয়ে নগরের খালিশপুর এলাকায় গৃহবধূ শিবানী দাসকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে হত্যা করেন তাঁর স্বামী কার্তিক রবিদাস। আলোচিত এ মামলাটিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ এখনো শেষ হয়নি। দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলা চালাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন শিবানীর বাবা মুখলাল রবিদাস।

খুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে এ রকম পাঁচ হাজারের বেশি মামলা। এই আদালতে শুরু থেকেই বিচারক সংকট ছিল। তিন মাস ধরে এখানে কোনো বিচারকই নেই। এতে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। অনেকে বিচারের আশাই ছেড়ে দিচ্ছেন।

২০১৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে নগরের লবণচরা থানার বুড়ো মৌলভি দরগা এলাকায় নিজ বাড়িতে ইলিয়াস চৌধুরী ও তাঁর মেয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা পারভীন সুলতানাকে শ্বাসরোধ করে হত্যার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় পারভীনের ভাই রেজাউল আলম চৌধুরী মামলা করেন। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা করেছিলেন। সেই মোতাবেক চার্জ গঠনের দিনও ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু বিচারক বদলি হওয়ায় বাদী হতাশ হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিচারক থাকলে এত দিন বিচারকাজ শুরু হয়ে যেত।’

ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতনের স্পর্শকাতর মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০০০ সালে খুলনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত হয়। কিন্তু অসংখ্য মামলার নিষ্পত্তিতে একটিমাত্র আদালত থাকায় শুরু থেকেই চাপ ছিল। গত বছরের ২৭ নভেম্বর এ আদালতের একমাত্র বিচারক মো. রবিউল ইসলাম বদলি হওয়ায় এখানে বিচারকশূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে জেলা ও দায়রা জজ নিজ দায়িত্বে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এতে করে নিজের আদালতের মামলার আপিল ও শুনানির পর তাঁর পক্ষে অন্য আদালতের মামলা নিষ্পত্তি করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়েছে।

সূত্রটি জানায়, চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এই আদালতে ৫ হাজার ২২৬টি মামলা ঝুলে ছিল। ২০১৬ সালের ১ জুন থেকে ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫৭০টি নতুন মামলা দাখিল হয়েছে।

সম্প্রতি প্রথম আলোর খুলনা কার্যালয়ে কথা হয় মিমির বাবা ইমাম হাওলাদারের সঙ্গে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, দিনমজুরি করে সংসার চালান। আসামিদের ভয়ে এলাকা ছেড়েছেন। এখন খুলনায় আসতেও ভয় পান।

শিবানীর বাবা মুখলাল রবিদাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আট বছর পার হলেও মামলার মীমাংসা হলো না। পাঁচ-ছয় মাস পরপর তারিখ পড়ে। বছরের পর বছর গাজীপুর থেকে খুলনায় যেতেও কষ্ট হয়। এখন বিচার পাওয়ার আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছি।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনার সমন্বয়কারী আইনজীবী মোমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ এই আদালতে দীর্ঘদিন ধরে মামলার জট ছিল। একেকটি মামলায় অনেক দিন পরপর শুনানির দিন ধার্য হতো। তিন মাস ধরে বিচারক না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো আরও বিলম্বিত হচ্ছে। এতে বাদীপক্ষ বিচার পাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। আদালত ও বিচারক না বাড়ালে এই দুর্ভোগ কমানো সম্ভব হবে না।