আ.লীগকে হারাতে একজোট হয়েছিল ভারত-যুক্তরাষ্ট্র

রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে গতকাল যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা l ছবি: বাসস
রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে গতকাল যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা l ছবি: বাসস

ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারাতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও যুক্তরাষ্ট্র একজোট হয়েছিল। তখন র-এর প্রতিনিধি ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের লোক বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয় হাওয়া ভবনে বসে থাকতেন বলেও মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
গতকাল শনিবার রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের উপস্থিত থাকলেও কোনো বক্তব্য দেননি। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা, যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আকতার, সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল প্রমুখ।
শেখ হাসিনা বিএনপির ভারত বিরোধিতার সমালোচনা করে বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে এত কথা বলে, এখানে সেই র-এর প্রতিনিধি, সে তো হাওয়া ভবনে বসেই থাকত। আমেরিকার দূতাবাসের লোক হাওয়া ভবনে বসেই থাকত। ২০০১ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণভাবে হারাবে এবং এখান থেকে গ্যাস নেবে।
আমি বলেছিলাম, আল্লাহ তাআলাই গ্যাস দেবেন না। বিক্রি তো দূরের কথা, এবং গ্যাস পায়নি। কিন্তু মুচলেকা তো দিয়েছিল। তাদের মুখে আবার এত ভারতবিরোধী কথা।’
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বলেন, ‘২০০১ সালের নির্বাচনের আগে আমেরিকান কোম্পানি আমাদের গ্যাস বিক্রি করতে চাইল ভারতের কাছে। ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়েছিল খালেদা জিয়া, দিয়েই তো ক্ষমতায় এসেছিল। আমি তো দিইনি। আমি চেয়েছিলাম আমার দেশের আগে দেশের মানুষের কাজে লাগবে, ৫০ বছরের রিজার্ভ থাকবে। তারপরে আমরা ভেবে দেখব বিক্রি করব কি করব না।’ তিনি বলেন, ‘আজকে শুনি খুব ভারতবিরোধী কথা। যারা ভারতের কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে পারেনি, এখন আবার খুব ভারতের বিরুদ্ধে কথা। এই সমস্ত খেলা তারা বহু খেলেছে। তাদের কোনো দেশপ্রেম নাই। ক্ষমতাটা তাদের কাছে ভোগের বস্তু।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি করে রেখে যান। আইন পাস করে রেখে যান। সংসদে সেই আইন পাস হয়। কই বিএনপি, জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া; যারাই ক্ষমতায় ছিল কেউ তো কখনো একবারের জন্যও সীমানার দাবি করেনি। সীমানা নির্দিষ্ট করার পদক্ষেপও নেয়নি। আমি বলব, করার সাহসও পায়নি। দালালি এমনভাবে ছিল যে, ওরা সে কথা উচ্চারণই করেনি।’ তিনি বলেন, ‘সমুদ্রসীমা, সেই আইনও জাতির পিতা করে রেখে যান। জিয়া, খালেদা, এরশাদ কোনো সরকার ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে কোনো আলোচনা, কোনো মামলা বা কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে? নেয়নি। যদি এতই দেশপ্রেমিক হবে দেশের এই সমস্যার কথা তোলেনি কেন?’
গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আরেকটা প্রশ্ন রাখি, ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এল। ক্ষমতায় এসে ভারত গেল। ভারত গিয়ে উনি বেশ ঘুরে-টুরে আসলেন। যখন এখানে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করল গঙ্গার পানির কি হলো। গঙ্গার পানির কথা, ওহ হো, ওটা বলতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।’
খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভারতবিরোধী কথা বললেন, তার আগে উনি গঙ্গার পানি আদায়ের জন্য ফারাক্কা পর্যন্ত লংমার্চও করেছিলেন। আন্দোলন করেছিলেন, কিন্তু ভারত গিয়ে গঙ্গার পানির কথা ভুলেই গেলেন। দালালিটা করে কে? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই আমরা কিন্তু গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করেছি।’
বিএনপির নেতাদের রাজপথে নামার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা নাকি ভয়ে রাস্তায় নামতেই পারে না। তো, এতই যদি ভয় থাকে, তাহলে রাজনীতি কেন? অবশ্য এটা তাদের অভ্যাস।’ যুব মহিলা লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে আমরা ক্ষমতায় আছি। কই, বিএনপির ওই রকম নেতা-কর্মী বা মহিলাদের ওপর নির্যাতন করি না। করলে তো করতে পারি, করতে পারতাম। কিন্তু আমরা তা করি না।’
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ৯৩ দিন তাঁর গুলশান কার্যালয়ের অবস্থানের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপির নেত্রী অফিসে বসে হুকুম দিল অত্যাচার করো, মানুষ মারো, আগুনে মানুষ পোড়াও। সবকিছু করো, যাতে সরকার উৎখাত হয়। উনি প্রতিজ্ঞা করে বসে ছিলেন, এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত উনি ঘরে ফিরে যাবেন না। আমি যদি ওনাকে জিজ্ঞাসা করি, উনি ঘরে ছিলেন, না রাস্তায় ছিলেন? উনি কী জবাব দেবেন?’
বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা অত্যাচার করে সরকার উৎখাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু জনগণ সাড়া দেয়নি। জনগণই তাদের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ঠেকায়। তখন এটা বন্ধ হয়।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে কিছু প্রতিক্রিয়া
আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাচ্ছেন। তার আগ দিয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র ও যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িয়ে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য বিভিন্ন মহলে কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। এরই প্রেক্ষাপটে বিএনপি, ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখার্জি এবং কলকাতায় বাংলাদেশের সাবেক উপহাইকমিশনার ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ন কবীরের প্রতিক্রিয়া নেওয়া হয়েছে।
ভারতের কাছে মুচলেকা দিয়ে বিএনপির ক্ষমতায় আসা এবং আওয়ামী লীগকে হারাতে তখন হাওয়া ভবনে র ও মার্কিন দূতাবাসের লোকজনের বসে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভিত্তি, সত্যতা ও প্রমাণ ছাড়া কোনো স্টেটমেন্ট কেউ করে থাকলে তাঁকে কিংবা তাঁদেরই তা প্রমাণ করতে হবে। আমাদের কিছু বলার নেই।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী বলেন, এ ধরনের কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা জনগণকে অস্বীকার করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালের নির্বাচন ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। জনগণের ভোটেই বিএনপি ক্ষমতায় গিয়েছিল।
হাওয়া ভবনে র-এর প্রতিনিধির উপস্থিতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকায় ভারতের (১৯৯৫-২০০০) সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখার্জি গতকাল দিল্লি থেকে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কবে, কোথায় যাচ্ছেন তার সবকিছুই হাইকমিশনারের জানার কথা নয়। ঢাকায় আমার দায়িত্ব পালনের সময় এমন কিছু ঘটলে, অর্থাৎ আমার জানার বাইরে কিছু ঘটলে তা নিয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক নয়।’
জানতে চাইলে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো সংবেদনশীল বিষয় জনসমক্ষে বলার সময় যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত দিয়ে উপস্থাপন করলে লোকজনের বুঝতে সুবিধা হয়। বাংলাদেশের কাছে বন্ধুদের এবং বন্ধুদের কাছে বাংলাদেশের প্রয়োজন ক্রমবিবর্তনশীল। তাই যেকোনো বিষয়কে সমসাময়িক প্রেক্ষাপট থেকে বিশ্লেষণ করলে এর যথার্থতা ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়।’