রাবেয়ার জবানিতে পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতার ইতিহাস

লোহার তারে চুল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো বিবস্ত্র নারীদের। এ অবস্থাতেই চলত ধর্ষণ। প্রতিবাদ করলে রড দিয়ে পেটানো হতো। ক্ষতবিক্ষত করা হতো যৌনাঙ্গ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পাকিস্তানি সেনাদের পৈশাচিক এসব নির্যাতনের সাক্ষী রাবেয়া। পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন থেকে রাবেয়াও বাদ যাননি। তবে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তখন ৩০ বছর বয়স রাবেয়ার। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে সুইপারের কাজ করতেন।

বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গেলেই দেখা যাবে বই আকারে বাঁধিয়ে রাখা ‘নির্যাতিতা রাবেয়ার জবানবন্দি’। পাতা ওল্টালে উঠে আসবে সে সময়ের পাকিস্তানি সেনাদের এসব পৈশাচিক নির্যাতনের চিত্র।

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ করে। রাজারবাগে বাঙালি পুলিশ সদস্যরাই প্রথম হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ করেন। কিন্তু ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনস দখল করে নেয়। ওই দিন রাতেই রাবেয়ার ওপর নির্যাতন চালায় পাকিস্তানি বাহিনী।

সুইপার রাবেয়াকে চিনতেন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া। তখন তিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের বেতার অপারেটর ছিলেন। গত বুধবার ২২ মার্চ জাদুঘরে গিয়ে দেখা হয় তাঁর সঙ্গে।

শাহজাহান মিয়া রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের খবর সারা দেশের পুলিশ লাইনসে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর পোশাক, চশমা, বেতারযন্ত্র জাদুঘরে রয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস দখল করে নেওয়ার পর পাকিস্তানি সেনারা ২৬ মার্চ রাবেয়াকে ধর্ষণ করে। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে-পায়ে ধরে রাবেয়া প্রাণে বেঁচে যান। হয়ে যান কালের সাক্ষী।

আরেক মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আলীর সঙ্গেও দেখা হয়। তিনি তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শকের দেহরক্ষী ছিলেন। কর্মরত ছিলেন রাজারবাগেই। ২৫ মার্চ আলীই প্রথম পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে সব পুলিশ সদস্যকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের খবর জানান। সেই পাগলা ঘণ্টি রয়েছে জাদুঘরে।

আলী প্রথম আলোকে বলেন, রাবেয়া পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের অন্যতম সাক্ষী। তাঁর বর্ণনা পড়ে কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারবে না। পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে বাংলার শত শত নারীকে ধরে এনে ধর্ষণ করেছে, যৌনাঙ্গে গুলি করে হত্যা করেছে।

তবে রাবেয়া এখন কোথায়, তা জানেন না দুজনের কেউই।

জাদুঘরে রাখা রাবেয়ার জবানবন্দির বর্ণনা থেকে জানা যায়, ২৫ মার্চ তিনি পুলিশ লাইনসের ক্যানটিনে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাতে বাঙালি পুলিশ পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে। তবে ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনারা পুলিশ লাইনস দখল করে নেয়। তারা খাবারের ওই ক্যানটিনে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাঙালি পুলিশ সদস্যদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। রাবেয়ার ওপরেও শুরু হয় নির্যাতন।

পাকিস্তানি সেনাদের পাশবিক অত্যাচারে মুমূর্ষু হয়ে পড়েন রাবেয়া। তখন তিনি সেনাদের হাত-পায়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। বলতে থাকেন, তিনি তো সুইপার। তাঁকে যদি মারা হয়, তাহলে কাজ কে করবে? এমন কথা শুনে রাবেয়াকে ছেড়ে দেয় সেনারা। তবে শর্ত থাকে, তিনি পুলিশ লাইনসের বাইরে যেতে পারবেন না।

রাবেয়ার বর্ণনা থেকে আরও জানা যায়, রাজাকার আর দালালদের সহযোগিতায় প্রতিদিন রাজারবাগে নিয়ে আসা হতো বাঙালি নারীদের। তাঁদের অনেকেই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থী। একদিন রাবেয়া ক্যানটিনের নালা পরিষ্কার করছিলেন। দেখেন, অল্পবয়সী কয়েকজন মেয়ের হাতে বই-খাতা। কয়েকজন নারীর শরীরে স্বর্ণালংকার। সবাই কাঁদছেন। তাঁদের দেখে পাকিস্তানি সেনারা কুকুরের মতো জিব চাটতে থাকে। এরপর শুরু হয় ধর্ষণ। ধর্ষণের পাশাপাশি নারীর শরীরের মাংস কামড়ে তুলে নেওয়া হয়। যাঁরা বাধা দিচ্ছিলেন, তাঁদের যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করা হয়। কেবল সাধারণ পাকিস্তানি সেনারা নয়, উচ্চপদস্থ সেনারাও নিয়মিত বাঙালি নারীদের রাজারবাগে ধর্ষণ করত। ঝুলন্ত নারীদের একমুহূর্তের জন্যও নামানো হতো না।

পাশবিক নির্যাতনের পর অনেক নারী মারা যেতেন। রাবেয়া দেখতেন, তাঁদের লাশ অন্য নারীদের সামনে কুচি কুচি করে কাটা হতো। এমন দৃশ্য দেখে আটকে রাখা অনেক নারী ভয়ে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতেন।

পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ‘নির্যাতিতা রাবেয়ার জবানবন্দি’ ছাড়াও আছে পুলিশ বাহিনীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ডায়েরি, কলম, রেডিও, জামা, চশমা, টুপি। আছে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্র, গোলাবারুদ। জাদুঘরের পরতে পরতে সাজানো আছে মুক্তিযুদ্ধের নানা দলিল।

জনপ্রিয় লেখক হ‌ুমায়ূন আহমেদের বাবার নাম ফয়জুর রহমান আহমেদ। তাঁর বাবা ১৯৪৬ সালে বেঙ্গল পুলিশে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পিরোজপুর মহকুমার সাব-ডিভিশনাল পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সহায়তা করেন। তাঁর ব্যবহৃত একটি রেডিও রাখা আছে জাদুঘরে।

জাদুঘরে ঢুকতেই চোখে পড়বে খাকি পোশাক পরা চারজন পুলিশের ম্যুরাল। এতে ব্রিটিশ আমল থেকে হাল আমলের পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি দেখানো হয়েছে। গোলাকার জাদুঘরটির দেয়ালজুড়ে টাঙানো আছে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা সাবেক পুলিশপ্রধান, শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি। এ ছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীসহ জাতীয় নেতাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন ছবি, সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনও বাঁধাই করে দেয়ালে টাঙানো হয়েছে। এর বাইরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে পড়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিকামী জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের ছবি স্থান পেয়েছে জাদুঘরে।

পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আরও আছে জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে গোলাম আযমের বৈঠকের ছবি, জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে মাওলানা মান্নানের ছবি। রাজাকার, আলবদর, আলশামস শিরোনামে বাঁধাই করা ছবিও রাখা হয়েছে জাদুঘরে। চার বছর আগে এই জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হয়।