ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলেও ঘাটতি আস্থায়

>

রাজধানীর কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল বিকেলে ‘বাংলাদেশ-ভারত সর্ম্পকের নতুন মাত্রা : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ছবিতে (বাঁ থেকে) মাহমুদ হাসান, শামীম আহমেদ, আমেনা মহসীন, মো: তৌহিদ হোসেন, জামিল ডি আহসান, আশফাকুর রহমান, হেমায়েত উদ্দিন, আ ন ম মনিরুজ্জামান, লাইলুফার ইয়াসমিন, আবদুল কাইয়ুম  ও মতিউর রহমান l ছবি: আশরাফুল আলম
রাজধানীর কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল বিকেলে ‘বাংলাদেশ-ভারত সর্ম্পকের নতুন মাত্রা : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ছবিতে (বাঁ থেকে) মাহমুদ হাসান, শামীম আহমেদ, আমেনা মহসীন, মো: তৌহিদ হোসেন, জামিল ডি আহসান, আশফাকুর রহমান, হেমায়েত উদ্দিন, আ ন ম মনিরুজ্জামান, লাইলুফার ইয়াসমিন, আবদুল কাইয়ুম ও মতিউর রহমান l ছবি: আশরাফুল আলম

প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখা নিয়ে প্রশ্ন। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত হত্যার মতো বিষয়গুলোর সমাধান সমতার ভিত্তিতে হতে হবে

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা সাম্প্রতিক ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে গেছে। তারপরও দুই নিকট প্রতিবেশীর সম্পর্কে আস্থার সংকট লক্ষ করা যায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত তিস্তার পানিবণ্টন সমস্যা অমীমাংসিত রয়ে গেছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হওয়ায় এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফর নিয়ে বেশ কৌতূহল তৈরি হয়েছে। কোন প্রেক্ষাপটে, কী প্রয়োজনে প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সহযোগিতার রূপরেখা হচ্ছে, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

গতকাল সোমবার বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে প্রথম আলো আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে সাবেক কূটনীতিক, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা এই অভিমত দিয়েছেন। তাঁদের মতে, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত হত্যা এবং বাণিজ্য ও যোগাযোগের মতো বিষয়গুলোর সমাধান ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে হতে হবে। তা না হলে এবারের সফর নিয়ে যে উচ্চাশা তৈরি হয়েছে, তা হতাশায় পরিণত হবে।

প্রথম আলোর সভাকক্ষে ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন মাত্রা: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের মধ্য সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে রয়েছে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে উত্থান-পতন আছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি আলোচনায় আসার কারণে এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর দুই দেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। প্রতিরক্ষা, তিস্তা, বাণিজ্য ও সীমান্ত নিয়ে তিনি আলোচনার সূত্রপাত করেন।

দুই দেশের প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতার রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান বলেন, ‘আমরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে যতটা সম্ভব শক্তিশালী করব। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর ওপর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকতে হবে। পৃথিবীর ৪০টিরও বেশি দেশ সাবমেরিন কিনেছে। কাজেই বাংলাদেশ কিনলে সমস্যাটা কোথায়! আর আমরা তো অন্য কারও পয়সায় কিনছি না। আমরা আমাদের গরিব বাঙালির পোশাকশিল্প, রেমিট্যান্স, করের টাকা—এসব দিয়েই আমরা কিনছি। আর এটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’

আশফাকুর রহমান বলেন, ভারতের যেমন পানির দরকার, বাংলাদেশেরও পানির দরকার। মিলেমিশে পানি সংরক্ষণ করতে হবে। তাই বাংলাদেশ গঙ্গা ব্যারাজ তৈরিতে গুরুত্ব দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারক—যা-ই করি না কেন, এর বাস্তবায়ন হবে একই ধারায়। কেন সামরিক সহযোগিতার প্রয়োজন হলো আর কেনই-বা ভারত জোরালোভাবে প্রস্তাবটি দিয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। এখন পর্যন্ত ভারতের গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, যৌথ উৎপাদনে তারা যেতে চাইছে। যার অর্থ হবে, আমাদের কেনাকাটার ওপর কিছু বাধ্যবাধকতা চলে আসবে। মনে রাখতে হবে, ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের সব সময় সীমাবদ্ধতা থাকে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে আমাদের সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।’

আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, নেপালের সঙ্গে ভারতের প্রতিরক্ষা চুক্তিতে তৃতীয় দেশ থেকে অস্ত্র আমদানির ব্যাপারে দুই দেশ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিধান ছিল। ভারতকে না জানিয়ে নেপাল চীনের কাছ থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র (এয়ার ডিফেন্স মিসাইল) কিনতে গেলে ভারত তাতে বাধা দেয়। কাজেই বাংলাদেশ এ ধরনের চুক্তি করতে গেলে কোনো সীমাবদ্ধতা থাকবে কি না, তা দেখার কথা বলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মোহসিন বলেন, ভারতকে বুঝতে হবে তাদের বন্ধুর প্রয়োজন আছে। এই চুক্তির প্রস্তাবে আস্থার সংকট আরও বাড়বে। কারণ, ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তির একটি ধারায় কোনো এক পক্ষকে তৃতীয় পক্ষ আক্রমণ করলে একে অন্যকে সহযোগিতার বিধান ছিল,যা নিয়ে পরে প্রশ্ন উঠেছে। কাজেই সাধারণ জনগণ যাতে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে বিভ্রান্ত না হন, সম্পর্ক নিয়ে আস্থার সংকট আরও না বাড়ে, সেটা নীতিনির্ধারকদের ভারতকে বোঝাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ‘র’-এর কথা তুলেছেন। এটি প্রমাণ করছে, তার মধ্যে বিরক্তি কাজ করেছে। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করছেন, বাংলাদেশ এ ধরনের হস্তক্ষেপের জন্য তৈরি নয়।

সাবেক রাষ্ট্রদূত শামীম আহমেদ বলেন, তিস্তা একটা বড় সমস্যা। সাধারণ মানুষ যারা বাণিজ্য বোঝে না, কানেকটিভিটি বোঝে না, তাঁরা কিন্তু পানিবণ্টনের বিষয়টি বোঝে। প্রতিরক্ষা চুক্তি হোক, সমঝোতা হোক কিংবা সাদা কাগজেই—যা-ই হোক না কেন, পানি না পেলে মানুষ সত্যি হতাশ হবে। তিস্তার ব্যাপারে এই সফরে কোনো প্রক্রিয়া বা সমঝোতার সুযোগ নেই। কারণ, একটা পানিবণ্টন চুক্তি এভাবে হয় না। এখানে কোনো উদ্যোগই নেই।

সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) জামিল ডি আহসান বলেন, ‘আমার প্রশ্ন, হঠাৎ করে প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রয়োজন হলো কেন? আমরা যদি ঘনিষ্ঠ বন্ধুপ্রতিম দেশ হয়ে থাকি, তাহলে তো বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, জঙ্গিবাদের ক্রমবর্ধমান হুমকিসহ অন্যান্য নিরাপত্তার ঝুঁকি দূর করতে পারি। আমরাই তো ভারতকে বেশি দিয়ে গেছি। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হস্তান্তরে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে তাদের ভারতের কাছে তুলে দিয়েছি। সামরিক চুক্তি বা সমঝোতার বিষয়ে রাখঢাক হচ্ছে বলে এ নিয়ে নানা রকম কথা হচ্ছে। এ ধরনের কারিগরি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে কারিগরি পর্যায়ে অনেক আলোচনার দরকার ছিল। তবে হওয়া উচিত।’

জামিল ডি আহসানের মতে, বিভিন্ন দেশে প্রতিরক্ষা বাহিনী নির্দিষ্ট ধরনের সমরাস্ত্র (ইলেকট্রনিকস, উইপন সিস্টেম, অ্যামুনিশন, রাডার) ব্যবহার করে থাকে। নানা রকমের আইটেম দিয়ে এটা হয় না। নানা ক্ষেত্র বা উৎস থেকে তা হয় না। দুটি কারণে—প্রথমত যারা এসব পরিচালনা করবে, তারা তো নানা রকমের জিনিস চালাতে পারবে না। তা ছাড়া খাপসই (কমপ্যাটিয়েবল) হওয়া প্রয়োজন।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহমুদ হাসান বলেন, ‘আসলে কী হবে তা প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরে বোঝা যাবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশের সবচেয়ে বড় কূটনীতিক। তাই তিনি যা-ই করবেন তার একটা প্রভাব পড়বে দেশে। তার হাতে অনেক ক্ষমতা, উনি কী করবেন, কী নিয়ে আসবেন, তা বোঝা যাবে। প্রধানমন্ত্রীর হাত আরও অনেক বেশি শক্ত হতো যদি দেশে রাজনৈতিক বিভাজন না থাকত। আর এটাই ভারত বারবার কাজে লাগাচ্ছে। তিস্তা চাইলেই দিতে পারে। কিন্তু দিচ্ছে না, এটা-ওটা বলে। দিচ্ছে না, কারণ আমরা দুর্বল। আমাদের একটা শক্ত পার্লামেন্ট নেই বলে তারা দিচ্ছে না।’

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হেমায়েত উদ্দিন প্রতিরক্ষা চুক্তি ও সমঝোতা চুক্তির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে উল্লেখ করে বলেন, ‘প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে তা ভালো করে পড়ে দেখতে হবে। আমি জানি না দুই পররাষ্ট্রসচিবের মধ্যে কী কথা হয়েছে। কিন্তু এটুকু বলতে পারব, হয়তো একটা নির্দেশনা বা ইঙ্গিত থাকবে, যেখানে দুই দেশের মধ্যে কিছু সহযোগিতার ইচ্ছার বিষয় আলোচনার কথা বলা থাকবে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই দুই দেশের মধ্যে আস্থার অভাব। আমাদের আরও বাস্তবিক হতে হবে, ভারত বাংলাদেশকে কীভাবে দেখছে, এটার বিষয়ে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা বেশ ছোট ভারতের তুলনায়। তাই বড় প্রতিবেশী নিয়ে গত কয়েক বছরে নীতিগতভাবে গুণগত একটা পরিবর্তন এসেছে। আমাদের দর-কষাকষির ক্ষমতা বেড়েছে। আমাদের ওপর সবকিছু চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। ভারতের দরকার শান্ত প্রতিবেশী।’

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেনের মতে, প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত কোনো চুক্তির প্রয়োজনীয়তা নেই। তিনি বলেন, ‘ভারত তার আশপাশের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুদ্ধে নামলে কি বাংলাদেশের সাহায্য তার প্রয়োজন পড়বে? আমি কোনো কারণ দেখি না।’ এই সমঝোতা চুক্তি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক মন্তব্য করে সাবেক এই পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘একটা কারণ হতে পারে, কয় দিন আগে আমরা যে সাবমেরিন কিনলাম চীন থেকে, তাতে ভারত অসন্তুষ্ট। ভারতীয় অস্ত্র কিনে তাদের খুশি করা যায় কি না, সেই চেষ্টা হতে পারে।’