ঘরে ফেরার অপেক্ষায় বাসিন্দারা

আতিয়া মহলের পেছনে আছে একটি প্লাস্টিকের বোতল তৈরির কারখানা। সেখানকার কারিগর নিখিলেশ দাস। কারখানার পাশে বসতঘরে থাকতেন। গত ২৪ মার্চ সকালে ঘর থেকে কারখানায় এসেছিলেন। এরপর আর ঘরে ফিরতে পারেননি। গতকাল শুক্রবার এক সপ্তাহ পূর্ণ হলো। নিখিলেশের প্রশ্ন, ‘বসতঘরে আর ফিরতে পারব কি?’
শুধু নিখিলেশ নন, সিলেটের দক্ষিণ সুরমার জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলে অভিযান শেষ হলেও এখনো নিজ ঘরে ফিরতে পারেননি ওই বাড়িসহ আশপাশের বাড়িগুলোর বাসিন্দা শতাধিক পরিবার। এর মধ্যে যাঁরা কর্মজীবী, তাঁরা পড়েছেন বেশি বিপাকে। পুলিশ ওই এলাকা ঘিরে রেখেছে। বাসিন্দারা এখনো জানেন না কবে আবার ফিরতে পারবেন নিজ ঘরে।
আতিয়া মহলের আশপাশের এক বর্গকিলোমিটার এলাকাসহ সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কে যানবাহন ও জনচলাচলে নিষেধাজ্ঞা গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে ওই সড়কসহ আশপাশের গলিপথ দিয়ে যান ও জনসাধারণের চলাচল শুরু হয়েছে।
পুলিশের হেফাজতে থাকার তিন দিন পরও আতিয়া মহল বিস্ফোরকমুক্ত করার কাজ শুরু হয়নি। সেখানে পড়ে থাকা দুজনের লাশও উদ্ধার করা হয়নি। মোগলাবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খায়রুল ফজল গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পৌঁছায়নি। এ কারণে বিস্ফোরকমুক্ত করার কাজে বিলম্বিত হচ্ছে। আজ শনিবার থেকে বিস্ফোরকমুক্ত করার কাজ শুরু করা হতে পারে।
নিখিলেশ আতিয়া মহলের কাছে থাকা প্লাস্টিক কারখানায় কাজ করছেন পাঁচ বছর ধরে। বললেন, অভিযান শুরুর দিন গত শুক্রবার এক কাপড়ে বেরিয়েছিলেন। আশ্রয় নিয়েছেন স্থানীয় কালীবাড়ি আখড়ায়। অভিযান শেষ হওয়ার পর প্রতিদিনই দূর থেকে দেখেন আতিয়া মহলসহ আশপাশ। একবার ঘরে যেতে পারলে দেখে আসতেন রক্ষিত সব ঠিক আছে কি না। কারণ, জীবনযাপনের সবকিছুই পড়ে আছে ওই ঘরে।
আতিয়া মহল পড়েছে সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের শিববাড়ি-পাঠানপাড়া এলাকায়। বাড়ির মালিক কাস্টমসের সাবেক কর্মচারী উস্তার আলী। জঙ্গি সন্দেহে ২৪ মার্চ বাড়িটি পুলিশ ঘিরে রাখার সময় তিনি পুলিশের কাছে বাড়ির ভাড়াটেদের তথ্যাদি দিয়েছেন। ওই তথ্য অনুযায়ী নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে ছিল জঙ্গিরা। ‘মর্জিনা বেগম’ নামের একজন ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই মর্জিনাই অভিযানে নিহত নারী জঙ্গি।
পাঁচতলাবিশিষ্ট আতিয়া মহলে মোট ৩০টি ফ্ল্যাট। এর মধ্যে ২৮টি ফ্ল্যাটের ৭৮ জন বাসিন্দা জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন। ২৫ মার্চ সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’-এর শুরুতে ওই বাসিন্দাদের সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
আতিয়া মহলের তৃতীয় তলার ১৭ নম্বর ও দ্বিতীয় তলার ৭ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকতেন যথাক্রমে আনিসুর রহমান ও নজরুল ইসলাম। দুজনই চাকরিজীবী। আনিস বলেন, ‘বলতে পারেন সারা জীবনের সঞ্চয় ওই বাসায় রাখা। এগুলো কী অবস্থায় আছে, একটু তো দেখার সুযোগ চাই।’
নজরুল সপরিবারে দক্ষিণ সুরমার একটি আবাসিক হোটেলে আছেন। তিনি বলেন, ‘জঙ্গিদের কারণে জীবন বিপন্ন ছিল। আমরা সর্বস্বান্ত হলাম। আমরা আবার কী করে ঘুরে দাঁড়াব?’
বাড়িটির পঞ্চমতলার ভাড়াটেদের একজন সরকারি চাকরিজীবী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, প্রথম দফায় উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের একজন তিনি। স্ত্রী ও এক সন্তানকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে এসে গত বুধবার প্রথম কর্মস্থলে যান। দুই দিন দুই জায়গায় রাত কাটিয়েছেন। আতিয়া মহল বিস্ফোরকমুক্ত হওয়ার পর পুলিশ পুরো এলাকা নজরদারির মধ্যে রেখে সবার আগে যেন বসবাসকারীদের প্রবেশ করতে দেয়।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) জেদান আল মুসা প্রথম আলোকে বলেন, আতিয়া মহলের ভেতরের অবস্থা কী, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আশপাশও নিরাপদ নয়। বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের তল্লাশি শেষে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি জানানো হবে।