'অশ্লীল চিত্র' প্রদর্শন নাকি চেয়ারম্যান পদের দ্বন্দ্ব?

জেন্ডার কোর্সের অংশ হিসেবে শ্রেণিকক্ষে ‘অশ্লীল চিত্র’ প্রদর্শন করার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক সাময়িকভাবে বরখাস্ত আছেন, যাতে উদ্বিগ্ন ওই কোর্স-সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা। প্রশ্ন উঠেছে, ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগের আদৌ কোনো সত্যতা রয়েছে, নাকি তিনি শিক্ষক রাজনীতির বলি?
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে এক সিন্ডিকেট সভায় উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রিয়াজুল হককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু অধ্যাপক রিয়াজুল অভিযোগ সম্পর্কে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানেন না বলে প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন। তিনি শুধু সিন্ডিকেটের একটি চিঠির মাধ্যমে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্তের কথা জেনেছেন। তাঁর বক্তব্য, বয়সের ক্রমানুসারে তাঁর এই বিভাগের পরবর্তী চেয়ারম্যান হওয়ার কথা। এ জন্য কেউ কেউ ষড়যন্ত্র করে তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।
অভিযোগ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, বিষয়টি উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের একাডেমিক কমিটি সিন্ডিকেটের নজরে আনে। একাডেমিক কমিটি সিন্ডিকেটকে জানায়, অধ্যাপক রিয়াজুল ক্লাসে যেসব কনটেন্ট (শিক্ষা উপকরণ) ব্যবহার করেন, তা কিছু কিছু কোর্সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসৌজন্যমূলক ও শালীনতার পরিপন্থী। তাঁর হ্যান্ডআউটে ব্যবহৃত শব্দ ও অভিব্যক্তি অনেকাংশে অপ্রাসঙ্গিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিন্ডিকেট সদস্য বলেন, বিষয়টি নিয়ে ওই শিক্ষককে একাধিকবার সতর্ক করা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, জেন্ডার ক্লাসে অবশ্যই সামাজিক সম্পর্ক পড়ানো হবে। কিন্তু এখানে যৌন সম্পর্কের কোনো ছবি দেখানোর সুযোগ আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এটি তদন্ত করতে সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।
বিশিষ্ট জেন্ডার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সাদেকা হালিম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অধ্যাপক রিয়াজুল হকের লেকচারের ছবি ও কনটেন্ট দেখেছেন। এর মধ্যে কোনোটিকেই অশ্লীল বলা যাবে না। তাঁর মতে, এই বরখাস্তের মাধ্যমে জেন্ডার-বিষয়ক পাঠদান নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার প্রস্তাব করে উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের ১০ জন শিক্ষক ১৪ মার্চ এক চিঠিতে সিন্ডিকেটকে বলেছেন, তাঁদেরও পাঠ্যক্রমের সঙ্গে নারী ও জেন্ডার বিষয়ে সারা দুনিয়ায় ব্যবহৃত তথ্যসূত্র, রচনাবলি ও শিক্ষণপদ্ধতি ব্যবহার করে পাঠদান করতে হয়। সে ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিনিয়ত এমন কিছু বিষয় ক্লাসে আলোচনা করতে হয়, যা প্রচলিত রক্ষণশীল মূল্যবোধের কাছে আপত্তিকর মনে হতে পারে।
শিক্ষকদের প্রশ্ন, ‘কিন্তু তাই বলে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও কি আমরা প্রাথমিক শিক্ষার সিলেবাস বিতর্কে যে রকম আত্মসমর্পণ করেছি, সে রকম আত্মসমর্পণ করব, নাকি ভালোভাবে কোনটা অপ্রয়েজনীয়, কোনটা প্রয়েজনীয় তা নির্ণয় করে পরবর্তীতে করণীয় নির্ধারণ করব?’
শিক্ষকদের এ চিঠি পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সব বিষয় বিবেচনা করেই তদন্ত কমিটি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
জেন্ডার কোর্সটি বিভিন্ন নামে বিভিন্ন বিভাগে পড়ানো হয়। অধ্যাপক রিয়াজুল হক যে কোর্স নেন, তার নাম ‘জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা ব্যাচের সান্ধ্য ক্লাসে কোর্সটি পড়ান। রিয়াজুল হক বলেন, ‘এঁরা সবাই চাকরি-বাকরি করেন। সবাই প্রাপ্তবয়স্ক। এখানে প্রস্টিটিউশন নিয়ে আলোচনা করা কি দোষের? ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে আলোচনা করা কি দোষের? ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা করা কি দোষের? ঘেটুপুত্র কমলা অশ্লীল সিনেমা? যদি অশ্লীল হয়ে থাকে, এই ছবি মুক্তি পেল কীভাবে?’
অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, তাঁর কোনো কোর্স নিয়ে বিভাগের শিক্ষার্থীরা বা ছাত্র উপদেষ্টা কেউ তাঁকে কিছু জানাননি। কোর্স শেষ হওয়ার এত দিন পর কেন এসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন করেন তিনি। তাঁর দাবি, ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে এটা সাজিয়েছেন।
এ সম্পর্কে জানতে বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। এ বিষয়ে তাই তিনি কোনো কথা বলতে চান না।
বিষয়টি নিয়ে দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। অনেকের প্রশ্ন, যেখানে প্রাথমিক শ্রেণি থেকে যৌনশিক্ষা চালু করার চেষ্টা চলছে, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে অশ্লীলতার মাত্রা কীরূপ, তা নির্ধারণ করবে কে? এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিভাগের কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থী মানববন্ধন করেছেন।