আট আসামির সাজা বহাল

ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় দুজনের মৃত্যুদণ্ড এবং নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীসহ ছয় আসামির বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রোববার এ রায় দেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, একজন ইমামের দায়িত্ব হলো মুসল্লিদের নামাজ পড়ানো এবং ইসলাম সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া। তিনি এমন কোনো বক্তব্য দেবেন না, যা দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদি কেউ ইসলাম ধর্ম বা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) অথবা অন্য কোনো ধর্ম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন, তাহলে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় আনার সুযোগ আছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।

রায়ের পর গতকাল সন্ধ্যায় বিবিসি বাংলাকে রাজধানীর কমলাপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব খাজা মোহাম্মদ আরিফ রহমান তাহেরি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে বলেছেন, তিনি এমন কোনো আইন করবেন না, যা ইসলামি শরিয়াহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে শরিয়াহবিরোধী কোনো আইন পাস হয়নি বা প্রস্তাব করা হয়নি।’ তিনি বলেন, তিনি অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছেন, দেশের বহু মসজিদে নিজস্ব বা দলীয় চিন্তাধারা থেকে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা উগ্র বা উসকানিমূলক কথা বলে থাকেন।

খাজা মোহাম্মদ আরিফ বলেন, ‘কাউকে মারলে শহীদ, বেঁচে থাকলে গাজি, ইসলাম কায়েমের জন্য হত্যা করতে হবে, বোমা মারতে হবে—এসব মতাদর্শে যেসব ইমাম বিশ্বাস করেন এবং খুতবায় আকারে-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেন, তাঁদের চিহ্নিত করে সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পল্লবী থানার পলাশনগরে নিজ বাড়ির সামনে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার রাজীব হত্যার ঘটনায় করা ওই মামলায় ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ রায় দিয়েছিলেন। বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাইকোর্টে আসা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিদের করা আপিল, জেল আপিল ও সাজা বাতিল আবেদনের শুনানি শেষে গতকাল এ রায় দেওয়া হয়। এই মামলায় হাইকোর্টে ছয় আসামির সাজা বাড়ানোর জন্য রাজীবের বাবার করা রিভিশন আবেদন গতকাল খারিজ হয়েছে। এটি ব্লগার হত্যার প্রথম ঘটনা এবং বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হওয়া প্রথম মামলা।

রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণে রাজীবের বাবা নাজিম উদ্দিন প্রতিক্রিয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার সন্তানকে যারা মেরেছে, তারা প্রমাণিত সন্ত্রাসী। তারা অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। তাই তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি তা পাইনি।’ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন কি না—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যতটুকু সুযোগ আছে, ততটুকু আপিল করব।’

রায়ে আদালত বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, অপরাপর সাক্ষীর সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বিচারিক আদালত সব সাক্ষ্য সঠিকভাবে পর্যালোচনা করে সাজা দিয়েছেন, এই রায়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। সাজা কমানোর মতো যুক্তি আসামিপক্ষ দিতে পারেনি।

হাইকোর্টের রায়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপের মৃত্যুদণ্ড এবং মাকসুর হাসান অনিকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রয়েছে। এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজকে ১০ বছর করে, মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানীকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে বিচারিক আদালতের দেওয়া তিন বছরের কারাদণ্ডও বহাল রয়েছে উচ্চ আদালতে। আট আসামিই কারাগারে আছেন।

অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে

জসীম উদ্দিন রাহমানী ছাড়া অপর সাত আসামি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিষ্কৃত ছাত্র। রায়ে আদালত বলেছেন, সাক্ষ্য, দলিলাদি ও আসামিপক্ষের যুক্তি থেকে দেখা যায়, মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানী ছাড়া অপর সাতজন অভিযুক্ত মেধাবী শিক্ষার্থী। তবে কেন তাঁরা এই পথে গেলেন, এই মামলায় তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ধরনের মেধাবী ছাত্র বিপথে যাওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। কেউ কেউ বলেন, অভিভাবকদের দায় বহন করতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অভিভাবকেরা শিক্ষিত ও সমাজে দায়িত্বশীল কাজে নিয়োজিত। তাঁদের উচিত ছিল সন্তানদের যথাযথ শিক্ষা দেওয়া, তবে তাঁরা তা দিতে পারেননি।

পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ‘আমরা নিজেদের লাইফস্টাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকি। সন্তানদের মানসিকতা ও তারা কী করতে চায়, কোন বিষয় পড়তে চায়, তা বিবেচনায় না নিয়ে আভিজাত্যের দিকে দৃষ্টি দিয়ে পড়াশোনাসহ অন্যান্য বিষয় তাদের মানসিকতার বাইরে চাপিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তারা মানসিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। এই চর্চা বন্ধ হওয়া উচিত। নিঃসন্দেহে বলা যায়, অভিভাবকেরাই সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষক। এ ক্ষেত্রে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রসহ সচেতন নাগরিকদের মানসম্মত শিক্ষা ও রাজনীতির পরিবেশ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, দেশের স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস ও ধর্মীয় সম্প্রীতি-সম্পর্কিত যথাযথ জ্ঞান সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।’

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, এ ধরনের মামলাসহ সব মামলায় এমন ব্যক্তিকে (তদন্ত কর্মকর্তা) নিয়োগ করা উচিত, যাঁর দেশের জনগণের জন্য কাজ করার কমিটমেন্ট আছে, যিনি আন্তরিকতার সঙ্গে সক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু দেবেন। তাহলে এ ধরনের অপরাধ সমাজ তথা দেশ থেকে কমবে। পুলিশের মহাপরিদর্শক দেশের স্বার্থে বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে দেখবেন।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল হক সেলিম। আসামিদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আবদুর রেজাক খান, মো. আহসান উল্লাহ, মোশাররফ হোসেন ও মো. আবদুন নূর দুলাল।

মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা রেদোয়ানুলের আইনজীবী আবদুন নূর দুলাল প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক বলেন, আসামিপক্ষ যদি আপিল করে, তাহলে রাষ্ট্রপক্ষ নিয়ম অনুসারে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করবে। আট আসামি কারাগারে আছেন।

বিচারিক আদালতের রায়ের পর গত বছরের জানুয়ারিতে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরি করা হয়। গত বছরের ৩১ অক্টোবর মামলাটি হাইকোর্টে শুনানির জন্য আসে। গত ৯ জানুয়ারি শুনানি শেষ হয়। রেদওয়ানুল ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার হন। এরপর তিনি সাজা বাতিল চেয়ে এবং ডেথ রেফারেন্সের শুনানিতে অংশ নিতে সুযোগ চেয়ে আবেদন করেন। এ বিষয়ে রুল হয়। গতকাল আদালত রায় দেন।