বিপন্ন সাংবাদিক পরিবার

মোতাহার হোসেন
মোতাহার হোসেন

লালমনিরহাটের এক সাংবাদিক ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। তিন বছর ধরে ওই সাংবাদিক নিজের বাড়িতে যেতে পারছেন না। পরিবারের সদস্যসহ নিকটাত্মীয়রা একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন।
হাতীবান্ধা উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণেই পরিবারটির বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক-এ ২০১০ সালের ৩ জুন ‘গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর নৈরাজ্য!’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে প্রতিমন্ত্রী, তাঁর ছেলে ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছিল। প্রতিবেদক ছিলেন সাপ্তাহিকের রাজশাহীর বিভাগীয় প্রতিনিধি সায়েম সাবু। তিনি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করছিলেন। প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওই মাসেই সায়েম, তাঁর তিন ভাই, বোন ও বোন জামাইসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা হয়।
এরপর গত আড়াই বছরে সায়েমের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টাকা ছিনতাই, ধানের চারা উপড়ে ফেলা, সার ও বীজ ছিনতাই, গাড়িতে আগুন, হামলা-ভাঙচুর, জমি দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২৩টি মামলা করা হয়। মামলায় লড়তে লড়তে পরিবারটি পর্যুদস্ত।
সাংবাদিক সায়েমের মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষকে হয়রানির জন্য কত রকম হাস্যকর মামলা হতে পারে, এ মামলাগুলো না দেখলে বুঝতাম না। এলাকার সম্ভ্রান্ত একটি পরিবারের বিরুদ্ধে বীজ ছিনতাই, সার ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ তদন্ত করে কিংবা আদালতে মামলাগুলো প্রমাণ করা যাচ্ছে না।’ আইনজীবী জানান, ১৩টি মামলা এখনো চলছে। ১০টি মামলা ভুয়া প্রমাণিত হওয়ায় পুলিশ আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মামলাগুলোর বাদীরা সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের ঘনিষ্ঠজন। এর মধ্যে একটি মামলা চালিয়ে নেওয়ার জন্য প্রতিমন্ত্রী নিজেও সুপারিশ করেছিলেন। তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশে পরে ওই মামলাটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় বাদীপক্ষ।
২৩টি মামলার মধ্যে ১৯টি করেছেন সানিয়াজান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গোলাম মান্নান এবং তাঁর চাচাতো ভাই ও ওই ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহাব আকন্দ। গোলাম মান্নান সাবেক প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই আলমগীর হোসেন ওরফে রন্টুর বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার। মান্নানের বড় ভাই স্থানীয় জামায়াতের নেতা।
এ ছাড়া রেশমা আক্তার, আতাউর রহমান, আবদুস সাত্তার এবং সানিয়াজান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে আরও চারটি মামলা করেছেন।
হাতীবান্ধা থানা সূত্রে জানা গেছে, এই সাংবাদিকের পরিবারের বিরুদ্ধে করা অধিকাংশ মামলার দেখভাল করতেন হাতীবান্ধা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনিসুর রহমান। তিনি সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনকে ধর্মপিতা ডাকেন। হাতীবান্ধা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও নয়টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এই এসআইয়ের বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে জেলা পুলিশ সুপারের কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
একই অভিযোগ, একই আসামি, একই সাক্ষী: ২০১২ সালের ২৭ জুলাই লালমনিরহাট আমলি আদালতে একটি মামলা করেন গোলাম মান্নান। ৩০ জুলাই আদালতে আরেকটি মামলা করেন আবদুল ওয়াহাব আকন্দ। দুই মামলাতেই সায়েম সাবুর পাঁচ মামাসহ সাতজনকে আসামি করা হয়। দুই মামলাতেই একই ব্যক্তিরা (চারজন) সাক্ষী। ঘটনার বর্ণনাও হুবহু এক। একই বছরের ২৮ নভেম্বর লালমনিরহাটের আমলি আদালতে আরেকটি মামলা করেন আবদুল ওয়াহাব আকন্দ। এই মামলায়ও সাক্ষী সেই পুরোনো চারজন। জমিজমার বিরোধ দেখিয়ে এ ধরনের ছয়টি মামলা করা হয়েছে।
পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের সর্বোচ্চ ৫৩ জন এসব মামলার আসামি। এর মধ্যে আছেন সাংবাদিক সায়েম সাবু, তাঁর মা লাইলী বেগম, ভাই ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন ও বিচারক লুৎফর রহমান, বোন রাশেদা আক্তার, বোন জামাই আবদুর রাজ্জাক, পাঁচ মামা আবুল হাশেম তালুকদার, আবদুল লতিফ, আবুল কালাম, আবুল হোসেন ও মকবুল হোসেন এবং এই মামাদের শ্যালক স্বাধীন শেখ অন্যতম।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন: সাংবাদিক সায়েম সাবু এখন ঢাকায় সাংবাদিকতা করেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রীর (সাবেক) ভয়ে ছদ্মনামে প্রতিবেদনটি করা হয়েছিল। কিন্তু আমার মোবাইল ফোনের কললিস্ট চেক করে তারা প্রতিবেদনের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করে। এরপর এলাকায় জনসভা করে আমার হাত কেটে ফেলার হুমকি দেন প্রতিমন্ত্রীর ছেলে।’
সায়েম সাবু বলেন, ‘তাঁরা ওই সংবাদের কোনো প্রতিবাদ করেননি। আদালতে বা প্রেস কাউন্সিলে কোথাও এ নিয়ে কোনো অভিযোগ দেননি। কিন্তু আমাকেসহ আমার পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজনকে জড়িয়ে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিচ্ছেন।’
সায়েমের বড় ভাই লোকমান হোসেন বলেন, ‘আমার এক ভাই সাংবাদিক। এক ভাই বিচারক। আমি মাস্টার্স পাস করে এলাকায় ব্যবসা করি। গত তিনটা বছর একের পর এক মামলায় আমরা ভয়াবহ সংকটে পড়েছি।’ একইভাবে হতাশার কথা জানালেন সায়েমের মামা হাশেম তালুকদার।
সায়েম সাবুর বড় বোন রাশিদা আক্তার সানিয়াজান ইউনিয়নের ওয়ার্ড মহিলা লীগের সভানেত্রী ছিলেন। বর্তমান সভানেত্রী ইসমত আরাও তাঁর বোন। এই পরিবারের সবার অভিযোগ, প্রতিমন্ত্রীর ক্ষোভের শিকার হয়েছেন তাঁরা।
হাতীবান্ধা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা মোহামঞ্চদ বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সানিয়াজানের লোকমান ও হাশেমদের পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এ নিয়ে কারও সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই পরিবারটির বিরুব্ধে এতগুলো মামলা কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাই বিষয়টি বুঝতে পারে। আমার কিছু বলার নেই।’
জানতে চাইলে ১৯ মামলার বাদী গোলাম মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জমি দখল করে তারা খাচ্ছে বলেই আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছি।’ প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশেই এসব মামলা করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সব মামলা সম্পর্কেই তিনি জানেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলেই মামলা করেছি।’ আপনার বড় ভাই কি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তিনি।
হাতীবান্ধা থানার এসআই আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরেই এসব মামলা হয়েছে। আমি কেবল আইন অনুযায়ী আসামি গ্রেপ্তার করেছি। এ কারণেই তারা আমার ওপর খেপেছে।’ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অবশ্যই ভালো।’
জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ওই পরিবারটি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিছু মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। কিছু মামলার তদন্ত চলছে।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হয়েছে। তবে নির্বাচনী কাজে আছেন বলে তিনি কথা বলতে পারেননি।
তবে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ছেলে হাতীবান্ধা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘সাংবাদিক সায়েমের মামা আবুল হাশেম তালুকদার এখানে ইউনিয়ন পরিষদের জন্য জমি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জমি নেওয়া হয়নি বলে ক্ষুব্ধ হয়ে সায়েম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। আর তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো জমিজমাসংক্রান্ত। গোলাম মান্নান ও ওয়াহাব আকন্দ মামলা করেছেন। সায়েমের পরিবারও পাল্টা মামলা করেছে।’ তবে সাংবাদিক সায়েম জানিয়েছেন, তাঁরা তিন ভাইয়ের কেউই কারও বিরুদ্ধে মামলা করেননি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বড়খাতা ইউনিয়ন ভেঙে সানিয়াজান নামে নতুন ইউনিয়ন গঠিত হয়। ওই ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় করার জন্য বিনা মূল্যে জমি দিতে চেয়েছিলেন হাশেম তালুকদার। কিন্তু তাঁর জমি নিলে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে স্থানীয় লোকজন তাঁর পক্ষে থাকবেন—এ কারণে সেই জমি নিতে দেননি প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন। এর বদলে গোলাম মান্নানের আত্মীয় হাবিবুল্লাহর কাছ থেকে জমি নেওয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মোতাহার হোসেনের পছন্দের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেন সাংবাদিক সায়েম সাবুর মামা আবুল হাশেম তালুকদার। ২০১১ সালের জুনের নির্বাচনে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর প্রার্থী আবদুল গফুর তৃতীয় হন। মাত্র ৫১ ভোটে পরাজিত হন হাশেম তালুকদারও। এর পর থেকে তাঁদের ও আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধেও একের পর এক মামলা হতে থাকে বলে জানান হাশেম তালুকদার। একপর্যায়ে তাঁরাও দুটি মামলা করেন।