বুড়ি ভৈরবের মৃত্যু ডেকে এনেছে ৫৩ দখলদার

একটা সময় জাহাজ চলত। স্মৃতিটা ধরে রেখেছে জাহাজঘাটা নামের একটি স্থান। কিন্তু সেই প্রমত্তা নদ এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় বুড়ি ভৈরব নামের নদটির এ অবস্থার জন্য দায়ী ৫৩ জন প্রভাবশালী। তাঁরা নদের জায়গায় শতাধিক পুকুর কেটেছেন, স্থাপনা বানিয়েছেন।

দখলদারেরা প্রভাবশালী হওয়ায় কিছুই করতে পারছেন না স্থানীয় ভূমি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। তবে তাঁরা ওই ৫৩ জনের তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দিয়েছেন।

জানতে চাইলে কালীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) যাদব সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এ উপজেলায় নতুন যোগ দিয়েছেন। দখলদারদের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। তবে নদের জমির শ্রেণি পরিবর্তন বা বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি তিনি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।

কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে এই বুড়ি ভৈরব নদ। কালীগঞ্জের মর্জাদ বাঁওড়ের স্লুইসগেট (জলকপাট) থেকে শুরু হয়ে গৌরিনাথপুর, নিত্যানন্দী, ঘোপপাড়া, সাতগাছিয়া, মাসিলা, ফুলবাড়ি, ঝনঝনিয়া হয়ে নদটি যশোরের নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদে মিলেছে। কালীগঞ্জ অংশে নদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার।

স্থানীয় কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বুড়ি ভৈরব নদটির কালীগঞ্জ অংশের তিন শতাধিক একর জমি দখল করে নিয়েছেন স্থানীয় ৫৩ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁরা নদের ভেতরে অবৈধভাবে শতাধিক পুকুর কেটেছেন। ফলে ১৭০ ফুট প্রস্থের নদটি এখন ৪০ ফুটে নেমে এসেছে।

কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বললেন, এত কিছুর পরও তাঁরা দখলদারদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছেন না। কারণ, দখলদারের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা রয়েছেন। তবে বছরখানেক আগে কার্যালয় দখলদারদের একটি তালিকা তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠিয়েছে উপজেলা ভূমি কার্যালয়।

সরেজমিন ঘুরে বুড়ি ভৈরবের দুরবস্থা চোখে পড়ে। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ গিলে ফেলেছেন নদটি। যেদিকে চোখ যায় শুধু পুকুর আর পুকুর। কালীগঞ্জের ওই তিনটি মৌজায় নদে শতাধিক পুকুর রয়েছে। এখনো পুকুর কাটার কাজ চলছে। একেকটি পুকুরের আয়তন এক থেকে ছয় একর। অনেক স্থানে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। ঘরবাড়ি আর পুকুরের মাঝে সামান্য একটু জলধারা রয়েছে। সেটাও এমনভাবে ঘিরে ফেলা হয়েছে, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই এটা একটা নদ। সেই সঙ্গে ওই জলাশয়ের ভেতরেও চাষাবাদ শুরু করেছেন দখলদার ব্যক্তিরা।

নদীপারের সাতগাছিয়া গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা ছিদ্দিকুর রহমান (৬৫) বললেন, ৩০-৪০ বছর আগেও বুড়ি ভৈরবে প্রচুর পানি থাকত। এলাকার লোকজন বর্ষার সময় নদে মাছ ধরতেন। তারও কিছুটা আগে এ নদে জাহাজ চলত। জাহাজ এসে থামত বারোবাজার এলাকার ঘাটে। সেই জায়গাটিকে এখনো সবাই জাহাজঘাটা নামেই চেনেন। তিনি জানান, ২৫-২৬ বছর আগে নদের দুই পাড়ে কিছু চর জাগে। তখন এলাকার এক শ্রেণির মানুষ চরের জমি দখলের চক্রান্ত করে। তাদের অনেকে ভূমিহীন মানুষ ধরে এনে তাদের নামে জমি বন্দোবস্ত নেয়। পরে নিজেরাই জমি দখল করে। মূলত ওই বন্দোবস্ত দেওয়ার পর থেকে নদের বারোটা বাজতে শুরু করে।

দখলকারীদের একজন ঘোপ গ্রামের তরিকুল ইসলাম। তাঁদের পরিবারের দখলে রয়েছে চার একর জমি। এ জমিতে তাঁরা ছয়টি পুকুর কেটেছেন। তরিকুল ইসলাম বলেন, তাঁরা ভূমিহীনদের কাছ থেকে জমি কিনে সেখানে পুকুর কেটেছেন। জমির শ্রেণি পরিবর্তন বা রেকর্ড দেওয়া সবই করছেন সরকারি কর্মকর্তারা। তাঁরা এগুলো না করলে জমি কেনাবেচা হতো না।

কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেল, কালীগঞ্জ উপজেলার তিনটি মৌজায় থাকা নদটির প্রায় ৩০০ একর জমির মধ্যে ১৯৮৯-৯০ সালে ৬৬ একর জমি ৬০ জন ভূমিহীনকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। মূলত চাষের জন্য বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। তাঁদের ১৩টি শর্ত দেওয়া হয়েছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শর্ত হলো জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না, পুকুর করা যাবে না, স্থাপনা গড়ে তোলা যাবে না, বর্গা দেওয়া যাবে না এবং বিক্রি করা যাবে না।

কিন্তু এসব শর্তের কোনোটিই মানা হচ্ছে না। নদের শ্রেণি পরিবর্তন করে শতাধিক পুকুর নির্মাণের পাশাপাশি অনেকে বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করেছেন ওই জমিতে।

এমন দখলদারদের একজন সাদিকপুর গ্রামের বজলুর রহমান। তিনি বলেন, তাঁর থাকার জায়গা ছিল না। এ কারণে নদীর জমিতে বাড়ি তৈরি করেছেন। তবে তিনি একা নন; এলাকার অনেকে এভাবে নদীর জমি দখল করছেন।

ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ের তালিকা মোতাবেক, দখলদারদের মধ্যে আরও রয়েছেন গৌরিনাথপুর গ্রামের শহিদুল ইসলাম (১ একর ৫০ শতক) ও হেদায়েত উল্লাহ (৩ একর); বেলাট গ্রামের স্বপন বিশ্বাস (২ একর ৩০ শতক)।

কাষ্টভাঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বন্দোবস্ত পাওয়া ভূমিহীনদের বেশির ভাগই শর্তগুলো ভঙ্গ করেছেন। মাত্র পাঁচ-ছয়জন ছাড়া অন্য ভূমিহীনেরা তাঁদের জমি প্রভাবশালীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেক প্রভাবশালী কৌশলে ভূমিহীনদের কাছ থেকে বন্দোবস্ত নেওয়া জমি দখল করে নিয়েছেন। যার দুটোই বন্দোবস্তের প্রধান দুই শর্তকে ভঙ্গ করে।