বাংলার বিরল বুনো গোলাপ

টাঙ্গুয়ার হাওরে খুঁজে পাওয়া বিরল প্রজাতির বুনো গোলাপ l ছবি: লেখক
টাঙ্গুয়ার হাওরে খুঁজে পাওয়া বিরল প্রজাতির বুনো গোলাপ l ছবি: লেখক

প্রায় এক যুগ আগে প্রথম যখন টাঙ্গুয়ার হাওরে যাই, তখন মাঝির কাছে শুনেছিলাম পানির নিচে লুকিয়ে থাকা এক রহস্যময় গোলাপ ফুলের কথা। মাঝি দূরে থিকথিকে কাদাজলমাখা একটি জায়গা দেখিয়ে বলেছিলেন, মাসখানেক পর জায়গাটা শুকিয়ে গেলে ওখানেই ফুটবে এই ফুল।

সেই ফুল দেখতে দুই বছর পর শুকনো মৌসুমে আরেকবার হাজির হয়েছিলাম হাওরে। এপ্রিলে নদীর পানি শুকিয়ে কাঠ। তাহিরপুর থেকে নৌকা পাওয়া গেল না। মোটরবাইকে চেপে সোলেমানপুর বাজারে এসে সেখান থেকে নৌকা পাওয়া গেল। হিজল বনে নৌকা থামিয়ে কয়েক মাইল ভেতরে ঢুকলাম। কোথাও জনমানুষের চিহ্ন নেই। হাওরের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে তৃণ-বিরুৎ, লতা-গুল্মের সমারোহ। বছরের সিংহভাগ সময় এই প্রান্তর ডুবে থাকে পানির নিচে। প্রায় হাঁটুসমান লম্বা ঘাস মাড়িয়ে যেখানটায় এসে দাঁড়ালাম, সেখানকার একটি ঝোপে দৃষ্টি আটকে গেল। দেখতে অবিকল গোলাপগাছ! প্রথমে ভাবলাম ভুল দেখছি। আশপাশে তাকিয়ে দেখি আরও কয়েকটি। বিস্মিত আমি। শুকিয়ে যাওয়া হাওরের তলদেশে গোলাপগাছ!

কিন্তু হায়, একটি ফুলও নেই গাছে। দু-একটি বাসি ফুল শুকিয়ে আছে ডালের মাথায়।

হন্যে হয়ে আরও খুঁজতে শুরু করলাম। অবশেষে দেখা পেলাম আরও কয়েকটি গাছের। গাছজুড়ে দুধিয়ালতার বিস্তার। দুই গাছে সাকল্যে দুটি ফুল পাওয়া গেল। একটি তরতাজা। অন্যটির একটি পাপড়ি নেই।

গোলাপ আবিষ্কারে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেও ফুলের দৈন্যদশায় হতাশ হলাম। বুঝলাম, আসতে একটু দেরিই করে ফেলেছি। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মাঝামাঝি এলে ভালো হতো।

পরের বছরগুলোতে চুলচেরা হিসাব মিলিয়ে সঠিক সময়ে হাওরে গিয়েছি। মন ভরে দেখেছি গোলাপের রূপ। অনুসন্ধানের ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে অনেক দূর অবধি। গোলাবাড়ী ক্যাম্প ছাড়িয়ে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ঘেঁষে প্রায় দুই মাইলের মতো পায়ে হাঁটা পথ। দুই পাশে হিজল-করচ-বরুণের পাশাপাশি অসংখ্য তৃণ-গুল্মের ঠাসবুনন। সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে বুনো গোলাপের ঝাড়।

এত দিন জানতাম, যে গোলাপ নিয়ে পৃথিবী এত মাতোয়ারা, সেই স্বর্গীয় ফুলের ঐতিহ্যে আমাদের কোনো হিস্যা নেই। হাওরের এই
বুনো গোলাপ সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। ধারণা করা হয়, এটিই পৃথিবীর একমাত্র জলসহিষ্ণু গোলাপ। বছরের দীর্ঘ সময় এই গাছ পানির নিচে ডুবে থাকে। পানি সরে গেলে শুকনো মাটিতে ধীরে ধীরে নতুন পাতা ও ফুলের কুঁড়ি গজাতে শুরু করে। পাপড়ি মেলে ফুল।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরদার নাসির উদ্দিন বলেন, ২০০৪ সালের দিকে তিনি প্রথম এই গোলাপ দেখেন। আমাদের প্রকৃতিতে এই গোলাপের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে বিশ্ব গোলাপের সঙ্গে এখানকার একটি ঐতিহ্যগত সম্পর্ক রয়েছে। তবে গাছটি বর্তমানে অতি বিপন্ন বলে জানান তিনি। বলেন, যেকোনো বিশেষায়িত বোটানিক্যাল গার্ডেনে গাছটি সংরক্ষণ করা উচিত। তা ছাড়া হাওরের মৎস্য সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রেও আরও সতর্ক হওয়া জরুরি। না হয় অতি দ্রুত প্রজাতিটি বিলুপ্ত হতে পারে।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ গ্রন্থে বলা হয়েছে, এই গোলাপ বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও মিয়ানমারে পাওয়া যায়। তবে গাছটি এখন বিপন্ন। বাংলাদেশে টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়া নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চলেও দেখা যেত।

বুনো গোলাপটির স্থানীয় নাম সেঁউতি। এটি বলিষ্ঠ ধরনের ঝোপালো গুল্ম। খাড়া বা অর্ধ আরোহী ধনুকের মতো শাখা-প্রশাখাযুক্ত। চ্যাপ্টা কাঁটা উপপত্রের জোড়ায় থাকে। পাতা ৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা। পাতা ও ডালপালা রোমশ বা মসৃণও হতে পারে। পত্রক সাধারণত এক জোড়া বা উপপত্রের নিচে সোজা, চ্যাপ্টা, কাঁটাযুক্ত, উপপত্র ছোট এবং ঝালরসদৃশ।

ফুল বৃন্তযুক্ত, মঞ্জরিদণ্ড বলিষ্ঠ, পত্র থেকে অনেক ছোট, মঞ্জরিপত্র দেড় সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। ঘনভাবে ক্ষুদ্র কোমল রোমাবৃত। বৃতিনল গোলাকার। বাইরের দিকটা বাদামি, খণ্ডক দেড় সেন্টিমিটারের মতো, ডিম্বাকার, ভেতরে রোমশ, ক্ষণস্থায়ী। পাপড়ির সংখ্যা পাঁচ, রং সাদা, ১ দশমিক ৭ থেকে ৩ সেন্টিমিটার লম্বা, প্রশস্তভাবে বিডিম্বাকার, শীর্ষ সখাঁজ ও মসৃণ। পুংকেশর অসংখ্য, গর্ভদণ্ড মুক্ত। ফল ১ থেকে ২ সেন্টিমিটার লম্বা, গোলাকার, ঘনভাবে কোমল রোমাবৃত। ফুল ও ফলের মৌসুম ফেব্রুয়ারি থেকে জুন। বৈজ্ঞানিক নাম rosa clinophylla