নিখুঁত রান্নায় মন জয় আকাশচারীদের

বড় বড় ট্রেতে থরে থরে সাজানো বাহারি সব খাবার—চিকেন টিক্কা মাসালা, গ্রিল চিকেন, বাটার চিকেন, ভেটকি মুনিয়ারি, মাটন কারাহি, ফ্রাইড রাইস, আরও কত কী। সব খাবার বেশ গরম-গরম। চুলা থেকে সদ্য তুলে রাখা। তাই খাবারগুলো থেকে উড়ছিল হালকা সাদা ধোঁয়া। নাকে যেতেই পেটে খিদে ধরে যায়। যেন চুম্বকের মতো টেনে নেয় খাবার-ভর্তি ট্রেগুলোর কাছে।

বাংলাদেশ বিমানের বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টারের (বিএফসিসি) রন্ধনশালায় গেলে এমন রকমারি সব খাবার কাছে টেনে নিয়ে যায়। এ ধরনের প্রায় ১০০ পদের খাবার রান্না করা হয় হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকার এই সেন্টারে। আর মানসম্মত খাবার ও কেবিন ড্রেসিংয়ের জন্য বিএফসিসিকে ‘এক্সিলেন্ট অন টাইম পারফরম্যান্স-২০১৬’ পুরস্কার দিয়েছে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ। জার্মানির হামবুর্গে ৬ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
বিএফসিসির এই সাফল্যের উৎস কী—এ খবর নিতেই প্রতিষ্ঠানটির রসুইঘরে চলে অনুসন্ধান। এ রন্ধনশালার রন্ধনশালার রন্ধ্রে রন্ধ্রে পাওয়া যায় পরিচ্ছন্নতা, নিষ্ঠা আর একাগ্রতার প্রমাণ।
বাংলাদেশ বিমান ছাড়াও বিএফসিসি থেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস, ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইনস, ড্রাগন এয়ার ও টার্কিশ এয়ারলাইনস খাবার নিয়ে থাকে। প্রতিদিন এসব বিমান সংস্থায় প্রায় আট হাজার যাত্রীর খাবার বিএফসিসির রন্ধনশালা থেকে সরবরাহ করা হয়। আসা-যাওয়া দুই পথের খাবার কিনে থাকে বাংলাদেশ বিমান। এ ছাড়া ঢাকায় এলে ইত্তেহাদ, কাতার, সৌদি, থাই, এমিরেটস, জেট এয়ার বিএফসিসির কাছ থেকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী খাবার কিনে থাকে।

একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব খাবার প্রস্তুত করার হয়। বিএফসিসিতে মুরগির মাংসের পদের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। ৩০ ধরনের খাবার রান্না করা হয়। সামুদ্রিক মাছের তৈরি খাবারের বেশ কদর রয়েছে আকাশপথের যাত্রীদের কাছে। মাছ থেকে ২০ ধরনের খাবার এখানে তৈরি থাকে সব সময়। বিএফসিসির ১৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের রন্ধনশালায় গরুর মাংস, খাসির মাংস, ভেড়ার মাংস থেকে ৩০ ধরনের খাবার রান্না করা হয়।

এ ধরনের প্রায় ১০০ পদের খাবার রান্না করা হয় হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকার এই সেন্টারে। ছবি: প্রথম আলো
এ ধরনের প্রায় ১০০ পদের খাবার রান্না করা হয় হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকার এই সেন্টারে। ছবি: প্রথম আলো

রন্ধনশালার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জানালেন, সাভারে বিমানের নিজস্ব পোলট্রি ফার্ম থেকে বিএফসিসির জন্য মুরগির মাংসের জোগান আসে। এখানে প্রতিদিন চাহিদা থাকে ১০০০ কেজি মুরগির মাংসের। ভোরবেলা পোলট্রি ফার্মে জবাই ও ড্রেসিং করে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিশেষ পরিবহনে মুরগির মাংস বিএফসিসিতে আনা হয়। এখানে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর মাংস ডিফ্রস্ট (ঠান্ডা ছাড়ানো) করে খাবারের ধরন অনুযায়ী ৪৫ মিনিটের মধ্যে কাটা হয়। এই সময়ের বেশি হলে সেই মাংস রান্নার জন্য গ্রহণ করা হয় না। মাংস কাটা-ছেলার কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের সবাইকে বিশেষ পোশাক, মাথায় কভার, মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরতেই হবে। এরপর শুরু হয় খাবার তৈরির প্রক্রিয়া। বিশেষ মেশিনে পানি ফুটিয়ে খাবার রান্না করা হয়। রন্ধনশালার তাপমাত্রাও নির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। রান্না করা খাবার ৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস চুলা থেকে তুলে ট্রেতে রাখা হয়। সেখান থেকে কোল্ড রুমে নিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনা হয়। খাবার রাখার পর এর প্রস্তুতির তারিখ প্রতিটি ট্রের পাশে স্টিকারের ওপর বসানো হয়। এসব খাবার দুদিন পর্যন্ত রেখে দেওয়া যায়। আর সব তথ্য বিএফসিসির তথ্যভান্ডারে সংরক্ষণ করা হয়।
উড়োজাহাজের আসা-যাওয়ার খাবার দুই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে হয়। এ ব্যাপারে বিএফসিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক জামাল উদ্দিন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ভূপৃষ্ঠে যেভাবে খাবার সংরক্ষণ করি, আকাশপথে এই পদ্ধতি একেবারে আলাদা। মনে রাখতে হবে, একটি উড়োজাহাজ ৩৬ হাজার ফুট ওপর দিয়ে চলাচল করে। এ ছাড়া উড়োজাহাজের অবস্থান, যাত্রীদের শারীরিক অবস্থা ও চাহিদা—সবকিছু বিবেচনায় আনতে হয়।’

এ ধরনের প্রায় ১০০ পদের খাবার রান্না করা হয় হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকার এই সেন্টারে। ছবি: প্রথম আলো
এ ধরনের প্রায় ১০০ পদের খাবার রান্না করা হয় হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকার এই সেন্টারে। ছবি: প্রথম আলো

বিএফসিসির চিফ শেফ মো. শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ফিরতি পথের খাবার মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সংরক্ষণ করে উড়োজাহাজে তোলা হয়; যা কিনা পাঁচ দিন পর্যন্ত রাখা হয়। ফেরার সময় প্যাকেট করা শীতল খাবার ওভেনে গরম করে যাত্রীদের পরিবেশন করা হয়।

একইভাবে সালাদ, কেক, রুটি, বিস্কুট, পুডিংজাতীয় খাবার বিশেষ মেশিনে তৈরি ও সংরক্ষণ করা হয়। প্রতিদিনের খাবার বিএফসিসির দোতলায় ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পুরো বিএফসিসি পরিদর্শন করে বিমান সংস্থাগুলো খাবার কেনার চুক্তি করে থাকে। খান মোশাররফ হোসেন বলেন, এখানে সব খাবার শতভাগ হালাল। ৫৮৫ জন কর্মী এখানে কাজ করেন। সরাসরি রান্না করেন ১২০ জন শেফ। প্রতি তিন মাসে সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। কর্মীদের খাবার বাইরে থেকে আনা হয় না। তাঁদের জন্য আলাদাভাবে বিএফসিসির পক্ষ থেকে রান্না করা হয়। কর্মীরা ইউনিফরম (বিশেষ পোশাক) পরে কাজ শুরু করবেন। আবার ফেরার পথে ইউনিফরম রেখে চলে যাবেন। প্রতিটি ইউনিফরম প্রতিদিন নিজস্ব লন্ড্রিতে পরিষ্কার করা হয়।

এ ছাড়া আকাশযাত্রীদের বিশেষায়িত খাবার চাহিদার কথা বিবেচনা করে বিএফসিসি সম্প্রতি ‘ডায়াবেটিক মিল এবং কিডস মিল’ চালু করেছে। দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসকে খাবার সরবরাহ করে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ১১৯ কোটি টাকা রাজস্ব আয় ও ২৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছে বিএফসিসি।

সুইডেনের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এয়ার সার্ভিসেস (এসএএস) ১৯৮৯ সালে বিএফসিসি প্রতিষ্ঠা করে। এটি বাংলাদেশে একমাত্র আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টার।