বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্পভবন দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের মৃত্যুর বিচার হয়নি চার বছরেও। সাভারে রানা প্লাজা ধসের এই ঘটনায় সরকারি কর্মকর্তাদের আসামি করা না-করা নিয়ে দীর্ঘ সময় নষ্ট করার পর এখন আর মামলা এগোচ্ছে না। সাক্ষ্য গ্রহণই শুরু করা হয়নি। আর এই সাক্ষ্য গ্রহণ না হওয়ার বিষয়টি জানেই না অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়।
জানা গেছে, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় করা হত্যা মামলার এ পর্যন্ত চার দিন তারিখ পড়লেও সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। ৪১ আসামির মধ্যে ৩ জনের ক্ষেত্রে মামলার কার্যক্রমের ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে। তবে পাঁচজনের ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ থাকার কথা জানিয়েছেন বিচারিক আদালতের সরকারি কৌঁসুলি।
এর আগে ছয়জন সরকারি কর্মকর্তাকে আসামি করার অনুমতি না পাওয়ার কারণে তিন বছর ঝুলে ছিল এই মামলা। সে সময় জনপ্রশাসন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুক্তি ছিল—যাঁরা বড় অপরাধ করেননি, তাঁদের আসামি করার অনুমতি তাঁরা দিতে পারবেন না। শ্রম আইন অনুযায়ী তাঁরা দোষী নন এবং দায়দায়িত্ব নেই বলেই তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার মঞ্জুরি দেওয়া হয়নি। তবে সরকারের অনুমোদন না পাওয়া সত্ত্বেও তাঁদের আসামি করে পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। আদালতও ওই অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে বিচার শুরু করেন। কিন্তু এখন তাঁরা সবাই জামিনে আছেন।
জানতে চাইলে শ্রমসচিব মিকাইল শিপার গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের যাঁদের নামে মামলা হয়েছিল, তাঁদের অনেকেই জামিন পেয়ে নিয়মিত অফিস করছেন, কেউ কেউ অবসরে গেছেন।
আবার একই ঘটনায় ইমারত আইনে করা অপর মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ হচ্ছে না জেলা ও দায়রা জজ আদালতে তিন আসামির করা রিভিশন অনিষ্পন্ন থাকায়। আর দুদকের করা মামলায় অভিযোগ গঠন হয়নি। আর এরই প্রেক্ষাপটে আজ সোমবার দেশের মানুষ পালন করবে রানা প্লাজা ধসের চতুর্থ বার্ষিকী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক নিহত হওয়ার পরও বিচার হচ্ছে না। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। আইন যে মানুষের সঙ্গে তামাশা করতে পারে, এর চেয়ে বড়ভাবে দেখানোর কিছু নাই।’ কল্পনা আক্তার আরও বলেন, ‘গত দুই বছরে ঘটে যাওয়া বড় কয়েকটি ঘটনার মামলার রায় কিন্তু হয়ে গেছে। সরকার যদি চায় কী করতে পারে, সিলেটের খাদিজার বেলায় দেখেছি। মেয়েটাকে কোপানোর পর কয়েক মাসের মধ্যে রায় হয়ে গেছে। দোষী সাজা পেয়েছে। কিন্তু রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৬ জন মানুষ মারা গেল, সেটির কোনো মূল্য নাই। শ্রমিক বলেই কি কোনো মূল্য নাই। এই মামলার আসামিরা কীভাবে জামিন পেল, তা বোধগম্য নয়। এভাবে চললে কারাগারে থাকা বাকি তিনজনও ছাড়া পেয়ে যাবে।’
রানা প্লাজার হত্যা মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ থাকার বিষয়টি জানেন না রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, যে নিম্ন আদালতে মামলাটি বিচারাধীন, সেই আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) কিংবা হাইকোর্টের যেসব বেঞ্চ থেকে স্থগিতাদেশ হয়েছে, সেখানে কর্মরত আইন কর্মকর্তাদের কেউ তাঁকে স্থগিতাদেশের বিষয়টি জানাননি। এটি জানলে সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হতো। তিনি বলেন, শিগগিরই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে রানা প্লাজা ধসে আহত ও পঙ্গু হন প্রায় ২ হাজার ব্যক্তি। হতাহত ব্যক্তিদের অধিকাংশই পোশাকশ্রমিক। এ ঘটনায় পরদিন ২৫ এপ্রিল সাভার থানায় দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে অবহেলাজনিত মৃত্যু চিহ্নিত হত্যা মামলাটি করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে অপর মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এ ছাড়া নিহত পোশাকশ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলি আক্তার খুনের অভিযোগ এনে আদালতে নালিশি মামলা করেন। সাভার থানা-পুলিশের করা মামলার সঙ্গে এই মামলাটির তদন্ত আদালতের নির্দেশে একসঙ্গে করা হয়।
এ ছাড়া দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ভবন নির্মাণের অভিযোগে আরেকটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়েছে।
আদালত ও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, তদন্ত শেষে গত বছরের ১ জুন হত্যা এবং ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে হত্যা মামলায় রানা প্লাজার কর্ণধার সোহেল রানা, কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাসহ ৪১ জনকে এবং ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। ১৪ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। আর হত্যা মামলায় বিচারকাজ শুরু হয় ১৮ জুলাই। হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে সোহেল রানা, সাভার পৌরসভার সাবেক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও সাইট ইঞ্জিনিয়ার সরোয়ার কামাল কারাগারে এবং ৩০ জন জামিনে আছেন। এক আসামি আবু বকর সিদ্দিক মারা গেছেন এবং অপর সাতজন পলাতক। অপর মামলায়ও ওই তিনজন কারাগারে আছেন। পলাতক আছেন চারজন। বাকিরা জামিনে রয়েছেন।
হত্যা মামলাটি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামানের আদালতে বিচারাধীন। এই মামলায় অভিযোগ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং আরেক আসামি মো. হাসান হাইকোর্টে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৯ অক্টোবর বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রমের ওপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ ও রুল দেন। সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোশাররফ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ওই স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়নি। আর তখন হয়তো অ্যাটর্নি জেনারেল বিদেশে ছিলেন, তাই তাঁকে বিষয়টি জানানো হয়নি।
আরেক আসামি সাভার পৌরসভার তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৩ নভেম্বর হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ তাঁর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ ও রুল দেন। এ ছাড়া কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগের পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. ইউসুফ আলী, ঢাকা বিভাগের পরিদর্শক (প্রকৌশল) মো. শহিদুল ইসলাম, সাবেক উপপ্রধান পরিদর্শক মো. আবদুস সামাদ এবং উপপ্রধান পরিদর্শক (সাধারণ, ঢাকা বিভাগ) মো. জামশেদুর রহমানের ক্ষেত্রেও মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছে বলে বিচারিক আদালতকে জানিয়েছেন তাঁদের আইনজীবীরা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারা নিশ্চয়ই চাইবে না মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। এই মামলা মীমাংসা হলে সোহেল রানা, মালিক ও যাদের বিল্ডিং কোড দেখার কথা ছিল, তাদেরই বেশি অসুবিধা হবে। আর শাস্তি হলে ক্ষতিপূরণ আদায় ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে। সেই অর্থে অনেকে ভাবেন, এরাই মামলাটি যাতে নিষ্পত্তি না হয়, সেই চেষ্টা করছে। আমার আরেকটি সন্দেহ, মামলায় ক্ষতিপূরণ নির্ণয়ের যে পদ্ধতি করতে বলা হয়েছে, সেটি যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে শ্রম আইনে এটি যুক্ত করার দাবি উঠবে। তাই এ মামলার বিরুদ্ধে কায়েমি স্বার্থ আছে।’
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে স্থায়ী কোনো প্রসিকিউশন সার্ভিস নেই। ফলে যাঁদের এ মামলাগুলো দেখভাল করার কথা কিংবা উচ্চ আদালতের কী আদেশ হলো, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষে যেসব আইনি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেগুলো নেওয়া হয় না বলে বহু মামলা ঝুলে যায়। আর মামলা ঝুলে গেলে পাঁচ-সাত বছর পর সাক্ষী-প্রমাণ হাজির করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দোষ প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। ফলে আসামিরা সহজে খালাস পেয়ে যান।’