শনির হাওরও শেষ

>

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরে বাঁধ ভেঙে পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর ধানি জমি। শনির হাওরের ভাটিতাহিরপুর এলাকা থেকে তোলা ছবি l আনিস মাহমুদ
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরে বাঁধ ভেঙে পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর ধানি জমি। শনির হাওরের ভাটিতাহিরপুর এলাকা থেকে তোলা ছবি l আনিস মাহমুদ

২৫ দিনের প্রাণান্তকর চেষ্টা ব্যর্থ। তলিয়ে গেল আরও ২২ হাজার একরের বোরো ধান

২৫ দিনের প্রাণান্তকর চেষ্টা শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির কাছে হার মানল। পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেল সুনামগঞ্জের সর্বশেষ হাওরটিও। কৃষক ও এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে টিকে ছিল শনির হাওর। সেখানে কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে গতকাল রোববার ভোর থেকে ঢুকতে শুরু করে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি। পানির তোড়ে ডুবে গেছে আরও ২২ হাজার একর বোরো জমি।

সর্বশেষ হাওরটিও তলিয়ে গেলে বাঁধ রক্ষার লড়াইয়ে শামিল হওয়া কৃষক ও হাওরপারের পরিশ্রান্ত মানুষগুলো বাকরুদ্ধ। কথা বলতে পারছিলেন না তাঁরা। কান্নায় কথা আটকে যাচ্ছে। কৃষকেরা বলেন, শনিবার রাত ১২টার দিকে হাওরের লালুগোয়ালা অংশে প্রথম দফা ভাঙন দেখা দেয়। দেড় শতাধিক লোক বালুর বস্তা ফেলে সেটি রাতেই মেরামত করতে সক্ষম হলেও ভোর চারটার দিকে ফের ভাঙন শুরু হয়। এরপর লালুগোয়ালা অংশের আরও তিনটি স্থানের বাঁধে ফেলা বালুর বস্তা সরে যায়। চোখের পলকেই হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করে। সকাল নয়টার মধ্যে হাওরের পাশে বউলাই নদীর অংশ দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢোকে। ১১টি বাঁধের মধ্যে ৫টি বিলীন হয়ে যায়। এরপর থেকে বাঁধ এলাকা আর নদী একাকার হয়ে যায়।

গতকাল দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো হাওর জলমগ্ন। বাকি আছে উত্তর দিকের কিছু জমি। বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকছে অবিরাম। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান বলেন, ‘ধানই তো কৃষকের প্রাণ। নিজেকে প্রাণহীন লাগছে।’ তিনি আরও বলেন, শনির হাওরপারের ‘আফরমারা’ অংশে ভোররাত থেকেই ছিল মানুষের ভিড়। সকাল নয়টা পর্যন্ত গ্রামবাসী এবং কৃষকেরা শেষ চেষ্টা করেছেন। শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টাই ব্যর্থ। শনির হাওরে ফসলহানির মধ্য দিয়ে সুনামগঞ্জে এক মৌসুমে এবার সব হাওরের গল্প এক হয়ে গেল। কোনো হাওরের ফসল আর রক্ষা পেল না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, শনির হাওর ডুবে যাওয়ায় জেলার ১ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান সম্পূর্ণভাবে পানিতে তলিয়ে গেল। শনির হাওরে ২২ হাজার একর বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল বলে জানালেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তাহিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুস সালাম। তিনি বলেন, হাওরে কৃষিজমির স্তর উঁচু-নিচু। উত্তরে কিছু অংশ এখনো পানিতে তলায়নি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উঁচু অংশ থেকে কিছু জমির ধান কেটে নেওয়া সম্ভব হবে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বললেন, ফসলহানির খবর পেয়ে তিনি নিজেও বিমর্ষ হয়েছেন। এ হাওরের আনোয়ারপুর বাজার এলাকার দিকে কিছু উঁচু জমি আছে। সেগুলোর ধান আগাম কাটার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরে গত ২৯ মার্চ থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢোকার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু নড়বড়ে বেড়িবাঁধে অবস্থান নেন হাওরপারের কৃষক ও গ্রামবাসী। প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। চার কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধের আফরমারা অংশের ১১টি স্থানে তাঁরা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছিলেন।

এবার পাহাড়ি ঢলে হাওরে প্রথম ফসলহানির ঘটনা ঘটে দিরাইয়ে। ৩০ মার্চ সকালে দিরাইয়ের বরাম হাওরের তুফানখালি ও চাপতির হাওরের বৈশাখী বাঁধ ভাঙার উপক্রম হয়েছিল। বাঁধ রক্ষায় স্বেচ্ছাশ্রমের প্রথম উদ্যোগও ছিল সেখানে। হাজারো কৃষক কাজ করছিলেন। শেষ রক্ষা আর হয়নি। এরপর থেকে একে একে শুরু হয় হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলহানি। গত শনিবার রাত পর্যন্ত শনির হাওর সুরক্ষিত ছিল। উপজেলার চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি হাওরপারের ৪০ গ্রামের মানুষকে নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষার কাজ করে টানা ২৪ দিন ফসলহানি টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ২৫ দিনের মাথায় গতকাল ভাঙল বাঁধ।

এক ফসলি অঞ্চল সুনামগঞ্জ। বছরে হাওরে মাত্র একটিই ধানের ফলন হয়। একে একে ১৩৩টি ছোট-বড় হাওরে ফসলহানি হয়েছে এবার। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ফসলি হাওর সদর উপজেলার দেখার হাওর, কানলার হাওর, তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওর, মহালিয়া হাওর, সমসার হাওর, গুরমার হাওর, দিরাইয়ের বরাম হাওর, চাপতির হাওর, শাল্লার ছায়ার হাওর, জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওর ও মইয়ার হাওর, বিশ্বম্ভরপুরের খরচার হাওর, আঙ্গারুলি হাওর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের সাংহাই হাওর, জামখলা হাওর, দোয়ারাবাজারের কনকখাই হাওর, চাতল হাওর, ছাতকের চাউলির হাওর, ডেকার হাওর, নাইন্দার হাওর।