এবারও বিতর্কিত প্রার্থীদের ছড়াছড়ি

‘একতরফা ও ভাগাভাগির’ নির্বাচনে বিতর্কিত ও অখ্যাত প্রার্থীদের ছড়াছড়ি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, তাদের সঙ্গী জাতীয় পার্টির একাংশ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলিয়ে অন্তত ২০ জন বিতর্কিত প্রার্থীর নাম পাওয়া গেছে, যাঁদের মধ্যে অনেকে নির্বাচনে জিততে যাচ্ছেন।
অথচ নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় তাঁদের অনেকে যেমন সমালোচিত, তেমনি কোনো কোনো প্রার্থীকে মানুষ চেনেই না। এর বাইরেও একাধিক অপরিচিত ও বিতর্কিত ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। চরম আতঙ্কজনক পরিস্থিতির মধ্যে আজ রোববার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিরোধী দলবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
এই ২০ জন ছাড়াও আরও অন্তত ২০ জন বিতর্কিত প্রার্থী ভোট ছাড়াই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
স্থানীয় সূত্র, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য, নিজেদের দেওয়া হলফনামা পর্যালোচনা করে ওই সব প্রার্থীর বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও সম্পদ বৃদ্ধির চিত্র পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, পরিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়ার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। প্রার্থী কম থাকায় এখানে সব মানুষের পছন্দের প্রতিফলন হচ্ছে না। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
কক্সবাজার-৪ আসনে সরকারদলীয় প্রার্থী বর্তমান সাংসদ আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে বিতর্কের শেষ নেই। মাদকদ্রব্য ইয়াবা চোরাচালান চক্রের সঙ্গে বদি ও তাঁর নিকটাত্মীয়দের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের আকিয়াব থেকে টেকনাফকেন্দ্রিক চোরাই কাঠের ব্যবসা ও চিংড়ি ব্যবসাও বদি নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ আছে।
যুবলীগের নেতা নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ভোলা-৩ আসনে গত উপনির্বাচনের সময়ে সাংসদ হন। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করছেন। উপনির্বাচনে সাংসদ হওয়ার পর তাঁর লাইসেন্স করা পিস্তলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আওয়ামী লীগেরই কর্মী ইব্রাহিম। ঢাকা সিটি করপোরেশন, খাদ্য ভবন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
উন্নয়নকাজ থেকে কমিশন আদায়, সাংবাদিক নির্যাতন, নিয়োগ-বাণিজ্যসহ নানা ঘটনায় সমালোচিত সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের প্রার্থী।
সুনামগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মুহিবুর রহমান মানিকের ছাতকের বাসায় ১৯৯৯ সালে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় একজন নিহত ও তিনজন আহত হয়েছিলেন। এর পর থেকে অনেকের কাছে তিনি ‘বোমা মানিক’ হিসেবে পরিচিত।
লালমনিরহাট-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন বিভিন্ন ঘটনায় সমালোচিত। তাঁর সহকারী একান্ত সচিব টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এ ছাড়া তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ আছে। মোতাহার হোসেনকে নিয়ে সংবাদ করায় এক সাংবাদিক পরিবারকে মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে চরমভাবে হয়রানি করার অভিযোগ নিয়ে পত্রিকায় সংবাদ হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে সরকারি দলের হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরীর ভাই মজিবর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। নিক্সন এবার ফরিদপুর-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
যশোর-৪ আসনে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি সরকারি দলের হুইপ শেখ আবদুল ওহাব। কিন্তু হুইপ হয়েও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন। ক্ষমতায় থেকে ওহাব অর্জন করেছেন সন্ত্রাসী ‘হাতুড়ি বাহিনী’ ও ‘গামছা বাহিনী’ লালনের দুর্নাম।
কুষ্টিয়া-৩ আসনের প্রার্থী আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ গত পাঁচ বছরে প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়ে পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছেন।
ঢাকা-১৫ আসনে সরকারদলীয় প্রার্থী কামাল আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধে মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে ভর্তি-বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। ভর্তিতে বেশি টাকা নেওয়ার খবরের তথ্য তৈরি করতে গিয়ে তাঁর হাতে এক নারী সাংবাদিক লাঞ্ছিত হয়েছিলেন।
পাশেই ঢাকা-১৬ আসনে সরকারদলীয় প্রার্থী ইলিয়াস মোল্লাহ বিভিন্ন ঘটনায় সমালোচিত। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সর্দার মোহাম্মদ মান্নানও (কচি) একসময় ক্যাডার রাজনীতি করতেন। ঢাকা-৭ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ হাজি মো. সেলিম। দখলবাজিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তিনিও বিতর্কিত।
ঢাকা-৬ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইদুর রহমান সহিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে। কয়েক দিন আগেও তাঁর বাসা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
ঢাকা-৪ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাও একসময় ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করতেন। ঢাকা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খান ক্ষমতায় থেকে গত পাঁচ বছরে ১০৭ গুণ সম্পদ বাড়িয়েছেন।
ঠিকাদারি কাজের ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে যুবলীগের নেতা শহিদ ইকবাল বিথার খুন হওয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত হন খুলনা-২ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মিজানুর রহমান।
ময়মনসিংহ-৭ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এ হান্নান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ছিলেন বলে ময়মনসিংহের নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ। তিনি তৎকালীন কনভেনশন মুসলিম লীগের ময়মনসিংহ জেলার সভাপতি ছিলেন।
নেত্রকোনা-১ আসনে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাননি বর্তমান সাংসদ মোশতাক আহমেদ রুহী। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। টাঙ্গাইল-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মুরাদ সিদ্দিকীও একসময় ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করতেন।
বাগেরহাট-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুর রহিম খান। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দুর্নীতির অভিযোগে তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। খুলনার আলোচিত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের সঙ্গেও তাঁর সখ্য থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল।