ডলারের দামের অস্বাভাবিক ওঠানামা রোধ করতে হবে

গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা করছেন সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। পাশে পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ l ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা করছেন সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। পাশে পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ l ছবি: প্রথম আলো

দেশে মার্কিন ডলারের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি শুধু বাজারের আচরণের কারণে হয়নি, এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে। এ ধরনের দ্রুত ওঠানামা ঠেকাতে হবে। তবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবেচিন্তে, চটজলদি নয়।
দৈনিক প্রথম আলো ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) আয়োজিত ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেছেন। গতকাল শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা উপস্থিত ছিলেন। প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুমের সঞ্চালনায় এই অনুষ্ঠানে ডলারের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি, প্রবাসী আয় কমে যাওয়া ও রপ্তানিতে গতি কমে যাওয়া, বিদেশে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় আসে।
বক্তারা ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি এড়াতে আমদানিকারকদের বিনিময় হার ঠিক করে (হেজিং) বিলম্বে মূল্য পরিশোধযোগ্য ঋণপত্র (ডেফার্ড এলসি) খোলা এবং গ্রাহকদের এ বিষয়ে সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংককে মুদ্রাবাজারে তদারকি ও নজরদারি বাড়ানো, রপ্তানি আয় বাড়ানো ও প্রবাসী আয় বৈধ পথে আনতে ব্যবস্থা নেওয়া, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন করা, অর্থ পাচার রোধ, ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে মুদ্রার ক্রয়-বিক্রয় বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলারের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি শুধু বাজারের কারণে হয়নি, সেখানে অবশ্যই অন্য কোনো বিষয় আছে। এর সঙ্গে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। রপ্তানি আয়ের গতি কমছে, প্রবাসী আয় কমছে। তিনি বলেন, হঠাৎ করে বেড়ে গেছে, হঠাৎ করে কমে গেছে—এ ক্ষেত্রে হঠাৎ করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সচেতন করা, হেজিং নিশ্চিত করা, বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতনতা, বাজার পর্যবেক্ষণ ও নজরে রাখার পরামর্শ দেন। বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর বিদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, এ সুযোগ ঢালাওভাবে দেওয়া যাবে না। দেশের ভেতরে সাফল্য পর্যালোচনা করে কিছু কিছু কোম্পানিকে সুযোগটি দেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আহমেদ জামাল বলেন, ডলারের দাম রাতারাতি দু-তিন টাকা বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক নয়। এটা বাজারের আচরণে হয়নি। ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রায় দায় কী রকম আছে, তা কবে পরিশোধ করতে হবে—এসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক চেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো থাকলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা আগাম বোঝা যাবে।
প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার বিষয়ে আহমেদ জামাল বলেন, সৌদি আরবে অনেক শ্রমিক নিজস্ব কর্মস্থলের বাইরেও কাজ করেন। কিন্তু সেই আয় তাঁরা বৈধ পথে আনতে পারছেন না। বৈধ পথে পাঠাতে গেলে আয়ের উৎস জানতে চাওয়া হয়। প্রবাসী আয় বিকাশ নামধারীদের মাধ্যমে পাঠানোর অভিযোগও অনেকটা বস্তুনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিদেশে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ প্রশ্নে আহমেদ জামাল বলেন, অনেকেই বিদেশে বিনিয়োগ করতে চায়। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক খুবই চাপে থাকে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থান হলো, দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় কত, টাকা নিয়ে সেখান থেকে কিছু ফেরত আসে কি না, তা দেখতে হবে। তিনি বলেন, রিটার্ন আসেই না বলা যায়।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে উন্নয়ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখতে হবে। বাংলাদেশ রপ্তানি আয় ৫ হাজার কোটি ডলার করতে চায়। কিন্তু টাকার মান ডলারের বিপরীতে বাড়ছে। এতে রপ্তানি খাতের সক্ষমতা কমে যায়। চার বছর ধরে বেসরকারি খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি স্থির হয়ে আছে। উৎপাদনশীল বেশির ভাগ খাতের প্রবৃদ্ধি জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়ে কম। তিনি বলেন, ডলারের দাম দু-এক টাকা ওঠানামা হতেই পারে। তবে নজর দিতে হবে মৌলিক বিষয়ে।
প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার বিষয়ে সাদিক আহমেদ বলেন, বিকাশে গিয়ে যদি মানুষ ৮৩ টাকা পায়, আর আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে কম পায়, তাহলে মানুষ বিকাশেই যাবে। প্রবাসীদের অধিকার আছে ভালো বিনিময় হার পাওয়ার।
আলোচনার শুরুতে বাফেদার সভাপতি ও মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ডলারের দাম এক দিনে ৩, ৪, ৫ টাকা বেড়ে যাবে, এটা যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি এক দিনে ২ টাকায় কমিয়ে দেওয়াতে কিছু কিছু ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি স্থানীয়ভাবে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার নীতিমালা করা, মুদ্রাবাজারে ব্যাংকের নেট ওপেন পজিশনের (এনওপি) হার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা, হেজিং নিশ্চিত করা, এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর অনুমানভিত্তিক বিনিময় হার নিয়ে লেনদেন করার বিষয়ে আলোচনা দরকার বলে উল্লেখ করেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে ভারসাম্য এখন ১২০ কোটি ডলার ঘাটতি আছে, গত বছর এ সময়ে তা ৩০০ কোটি ডলার বেশি ছিল। কিন্তু ডলারের দামে এর ততটা প্রতিফলন দেখা যায়নি। তিনি বলেন, গত ১০ বছরে লন্ডনের আন্তব্যাংক লেনদেনে সুদের হার (লাইবর) ৭ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল। সেখানে অনেক ওঠানামা ছিল, তবে অস্থিরতা কম ছিল। বাংলাদেশে গত কয়েক দিনে ডলারের দামের যে অস্থিরতা, তা সবার জন্য ক্ষতিকর।
বিদেশে অর্থ পাচারের প্রসঙ্গ তুলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোকে ভারতীয়দের কত টাকা আছে, সে বিষয়ে সে দেশের সরকার তথ্য চেয়েছে। এতে পরের বছর দেখা গেল, সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের টাকা রাখা কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশ তথ্য চাওয়ার কথা বললেও পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে সেখানে বাংলাদেশিদের অর্থ জমা বেড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এম এ তসলিম বলেন, রপ্তানি আয় শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বেই কমেছে। এখন বেশি চিন্তার কারণ প্রবাসী আয় কমে যাওয়া। এত দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ না থাকলে ডলারপ্রতি দর ৭০ টাকায় নামত বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডলারের দামের একটি গড় মূল্য ধরে রাখার চেষ্টা ভালো। তবে আমার মনে হয়, সামনে ডলারের দাম কিছুটা বাড়বে।’
ডলার কেনাবেচার ক্ষেত্রে দামের পার্থক্য দুই টাকা থেকে কমিয়ে আনার তাগিদ দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী। প্রবাসী আয় কমে যাওয়াকে উদ্বেগের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা গোষ্ঠী প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে। বাংলাদেশে তাদের লোক সেই অর্থের বিপরীতে টাকা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা বেশি দামে টাকা পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করছে।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, বাংলাদেশি প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রার মান কমেছে। বাংলাদেশের এত দিন কমেনি। এতে রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে। ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের ক্রেতারা এখন ইউরো ও পাউন্ডে ঋণপত্র খুলতে চান উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ দুটি মুদ্রার কেনা ও বেচার দরের পার্থক্য পাঁচ-সাত টাকা। এখানে নজর দেওয়া উচিত।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুস সালাম বলেন, ‘সরকারি ব্যাংক হিসেবে আমাদের অনেক দায়িত্ব আছে। চাইলেই আমরা ডলারের দাম বাড়িয়ে দিতে পারি না। অন্য ব্যাংক এসব মানে না।’
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেটের প্রধান আলমগীর মোর্শেদ বলেন, এখন দেশের সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো তিন ধরনের দামে ডলার লেনদেন করছে। এটার কীভাবে ঠিক করা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের জন্য একটা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পলিসি ইউনিট থাকা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন।
অগ্রণী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রধানীয়া বলেন, কিছু ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং করছে, অথচ তাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয় নেই। এসব দেখতে হবে। বাজারের সবাইকে যৌক্তিক ও নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে হবে।