শ্রমিকের বিচার পেতে যত বাধা

ট্রেড ইউনিয়ন করার দায়ে ১৯৯৬ সালে ঢাকার মহাখালীর নিশান গার্মেন্টস লিমিটেড থেকে চাকরিচ্যুত করা হয় শ্রমিক নাহিদুল ইসলামকে। তিনি এর প্রতিকার পেতে শ্রম আদালতে মামলা করেন ১৯৯৭ সালে। ২০০৬ সালে তাঁকে চাকরিতে বহালের পক্ষে রায় দেন আদালত। এই রায়ের পর তা কার্যকর করতে আবার তাঁকে মামলা করতে হয়। ২০০৯ সালে শেষতক মালিকের ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং নাহিদকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিয়ে রায় দেন আদালত। ছয় মাসের কারাদণ্ড হলেও মালিক এক দিনের জন্যও কারাভোগ করেননি। এরপর আপসের মাধ্যমে মালিকের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছান নাহিদ। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘মোট সাড়ে ১৩ বছর লাগল আমার মামলার রায় পেতে। এর মধ্যে দুটি পরিবর্তন হয়েছে। আমি শ্রমিক থেকে শ্রমিকনেতা হয়ে গেছি। আর আমার কারখানার মালিক দেউলিয়া হয়ে কারখানাই উঠিয়ে দিয়েছেন।’ 

এভাবে শ্রম আইনে মামলা করে বছরের পর বছর অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় সমাজের অপেক্ষাকৃত আর্থিকভাবে অনগ্রসর শ্রমিকদের। শ্রম আদালতে সুবিচারের জন্য আশ্রয় নেওয়া শ্রমিকের বাস্তব অবস্থা এমনই করুণ বলে জানান শ্রমিক, শ্রমিকনেতা, শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি, আইনজ্ঞ ও গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, শ্রমিকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলেও শ্রম আদালতের সংখ্যা কম হওয়া, শ্রম আইনের দুর্বলতা, অবকাঠামোর অভাব, দুই মন্ত্রণালয়ের দ্বৈত শাসনকে দায়ী করেছেন। অধিকারকর্মীরা বলছেন, আইনি কাঠামো এমনভাবে করে রাখা হয়েছে, যাতে শ্রমিক সুবিচার না পান।
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে ছয়টি শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ঢাকায় তিনটি এবং চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে তিনটি আদালত স্থাপিত হয়। ১৯৯৪ সালে এ চট্টগ্রামে আদালতের সংখ্যা একটি বেড়ে মোট আদালত হয় সাতটি। ১৯৭২ সালে দেশে শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১০ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৩ অনুযায়ী, দেশে ৫ কোটি ৮১ লাখ মানুষ কাজে নিয়োজিত আছে। একাধিক শ্রমিক সংগঠনের অনুমান, শ্রমিকের সংখ্যা হবে প্রায় চার কোটি। তবে এই বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের কোনো আইনি সুবিধা পেতে ওই সাত আদালতেরই দ্বারস্থ হতে হয়।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আবু তাহের তাঁর ‘বাংলাদেশের শ্রম আদালতের অবস্থা’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, শ্রম আদালতে একটি মামলার রায় পেতে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। শ্রম অধিদপ্তরের লেবার জার্নালের তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১৪ সালে ৯৫ শতাংশ মামলাই অনিষ্পন্ন থেকে গেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের শুরুতে দেশের সাত আদালতে মামলার সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ৫৮২। এ বছর নিষ্পন্ন হয় ৭ হাজার ২৭টি মামলা। তবে এ বছর নতুন করে যুক্ত হয় ৬ হাজার ৯৫৩টি মামলা। বছর শেষে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা থেকে যায় ১৫ হাজার ৫০৮টি।
শ্রম আদালতের সংখ্যা কম হওয়ার পাশাপাশি শ্রম আইনের দুর্বলতা এ মামলার জটিলতার কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শ্রম আইনের ২১৬ ধারায় ৬০ দিনের মধ্যে রায় দেওয়ার কথা বলা আছে। তবে ওই ধারায় এ কথাও বলা আছে, যদি রায় বিলম্বে হয়, তবে তা অবৈধ বলে গণ্য হবে না।
শ্রম আদালত আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম আহসান খান বলেন, এভাবে মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অনির্দিষ্ট সময়ের সুযোগ সবাই নেয়। এর সংশোধন দরকার। আবার ৬০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করে ফেলার সময় নির্ধারণ করলেও তা বেশি হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে ছয় মাসের মধ্যে মামলা শেষ করে দেওয়ার বিধান রাখা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমাদের আইনজীবীদের দোষ আছে। আমরা আদালতে থেকেও মিথ্যে কথা বলি যে আমরা উপস্থিত নেই। এর পরিবর্তন করতে হবে।’
শ্রম আইন অনুযায়ী একজন জেলা জজ পদমর্যাদার চেয়ারম্যান এবং দুজন সদস্যের সমন্বয়ে আদালত গঠিত হয়। তবে রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু চেয়ারম্যান একা নন, বাকি দুই সদস্যেরও উপস্থিতি দরকার হয়।
অনেক ক্ষেত্রে দুই সদস্যের একজনের উপস্থিতি থাকে না। ফলে বছরের পর বছর মামলা পড়ে থাকে।
অধ্যাপক মো. আবু তাহের বলেন, আইনে পরিবর্তন এনে শুধু চেয়ারম্যান রায় দিতে পারবেন—এমন বিধান রাখা উচিত। আর ভারতেও ৬০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার কথা বলা আছে। তবে পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে অবশ্যই মামলা নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা আছে। এ জন্য আইনে পরিবর্তন দরকার।
শ্রম আদালতে বিচার পক্ষে না গেলে সংক্ষুব্ধ কেউ সরাসরি হাইকোর্টের মাধ্যমে রিট করার সুযোগ পান। শ্রম আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর সুবিধা প্রায় সব ক্ষেত্রেই নেন মালিকপক্ষ। আর এভাবে বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘ করে ফেলা হয়। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সরাসরি আপিলের সুযোগ রাখা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা। এতে মামলা নিষ্পত্তিতে সময় কমবে।
বিলসের বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, যদি ময়মনসিংহের চাতালের কোনো শ্রমিক তাঁর দেনমোহরের দাবি করতে চান, তবে তিনি সেখানেই এর প্রতিকার পেতে পারেন। তবে সেই শ্রমিকই যখন তাঁর মালিকের কাছে পাওনাসংক্রান্ত কোনো দাবি করতে চান, তবে তাঁকে ঢাকায় আসতে হবে। সুলতান উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের দেশে যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন কম শক্তিশালী, সেখানে আইনের আশ্রয় নেওয়ার জন্য শ্রমিকের শেষ জায়গা আদালত। সেখানেই যদি তাঁকে এত দীর্ঘসূত্রতার কোপানলে পড়তে হয়, তবে তা হতাশাজনক। তিনি বলেন, শ্রমিকের প্রতি রাষ্ট্রীয় অনীহার প্রতিফলন এসব।
শ্রম আদালতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, আর বিচারক নিয়োগের বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে। এর ফলে একধরনের দ্বৈত শাসনের সৃষ্টি হয়, এমন কথাও বলেন একাধিক বিশেষজ্ঞ। আদালত ভবনগুলোর দৈন্যদশা, ক্যানটিন বা শৌচাগারের অভাব—এসব সমস্যায় বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে।
শ্রম আইন এবং বেশ কিছু অবকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে বলে স্বীকার করেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইন সংশোধনের একটি উদ্যোগ আমরা নিচ্ছি। আর সরকার সম্প্রতি সিলেট ও রংপুরে দুটি শ্রম আদালত স্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেগুলো যথেষ্ট নয়।’ তবে মামলার জট কমাতে আইনজীবীদেরও সচেষ্ট হতে হবে বলে মনে করেন প্রতিমন্ত্রী।