নারী পুলিশের দুঃসাহসিক অভিযান

তাওহীদা আক্তার
তাওহীদা আক্তার

কিশোরী আত্মীয়কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই খবর পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠেন বাগেরহাট জেলার বাসিন্দা তাওহীদা আক্তার। নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় জড়িত এমন তথ্যও পান তিনি। নানা সূত্র ধরে একসময় জানতে পারেন, চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিশোরীকে। পেশায় পুলিশ কনস্টেবল তাওহীদা নিজেই কিশোরীকে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রামে এসে কখনো ভিক্ষুক, কখনো অসহায় নারী সেজে নগরের অলিগলি, বস্তি চষে বেড়ান। তাঁর কৌশলে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয় কিশোরীকে। গত রোববার ভোরে চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার ট্যানারি বটতল এলাকার একটি ভাড়া বাসা থেকে স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতায় কিশোরীকে উদ্ধার করেন তিনি। ওই কিশোরীকে চট্টগ্রামে নিয়ে আসা আত্মীয় বাবুল ফরাজীও এ সময় ধরা পড়েন। পেশায় কাঠমিস্ত্রি বাবুল ফরাজীর স্ত্রী-সন্তান রয়েছে।
তাওহীদা খুলনা জেলা পুলিশ লাইনসে কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত। ১ মে ছুটি নিয়ে তিনি চট্টগ্রামে আসেন। অভিযানের সাত দিনের মাথায় তিনি কিশোরীকে উদ্ধার করেন। তাঁর এই দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনি জানার আগে কিশোরীকে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি জেনে নেওয়া যাক। বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে ঘর ছাড়ে সে। কিন্তু বিপদ তার পিছু ছাড়েনি।
তাওহীদা বলেন, ওই কিশোরীর মা ঢাকায় কাজ করেন। মেয়েকে নিজের সঙ্গে রেখে লেখাপড়া করানোর সামর্থ্য নেই তাঁর। সে কারণে গ্রামে অসুস্থ বাবার সঙ্গে থাকত কিশোরী। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর কিশোরীর বিয়ের জন্য সবাই তোড়জোড় শুরু করে দেয়। কিন্তু সে এখনই বিয়ে করতে রাজি ছিল না। বিয়ে থেকে বাঁচতে দূর সম্পর্কের আত্মীয় বাবুল ফরাজীর (৪৫) সঙ্গে যোগাযোগ করে। গত ২২ মার্চ ফরাজীর সঙ্গে বাড়ি থেকে চট্টগ্রামে চলে আসে সে। এরপর ফরাজী আটকে ফেলেন কিশোরীকে। এক মাস ধরে নানা জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে মেয়েকে না পেয়ে গত ২২ এপ্রিল বাগেরহাট সদর থানায় মামলা করে কিশোরীর মা।
চট্টগ্রামে আসার পর তাওহীদা জানতে পারেন, নগরের পাহাড়তলী হাজী ক্যাম্প এলাকায় ওই কিশোরীকে নিয়ে একটি বাসায় আছেন বাবুল ফরাজী। ওই এলাকার বিভিন্ন দোকানে ও লোকজনের কাছে তিনি নিজেকে স্বামী পরিত্যক্তা পরিচয় দেন। তাঁর সঙ্গে ছিল বাবুল ফরাজী ও ফরাজীর ছবি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পুরো এলাকায় ঘুরে ঘুরে লোকজনকে দুজনের ছবি দেখাতেন। এতে লাভ হয়নি। এরপর নগরের ষোলোশহর, ২ নম্বর গেট, মুরাদপুর, জিইসি মোড়, অক্সিজেন মোড় ও ইপিজেড এলাকা চষে বেড়ান তিনি। বিভিন্ন পোশাক কারখানায়ও খোঁজ নিতে বাদ রাখেননি। এভাবে তাঁর পাঁচ দিন কেটে যায়।
তাওহীদা বলেন, পারিবারিক একটি সূত্রে জানতে পারেন, বাবুল ফরাজীর এক বোন বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার ট্যানারি বটতলে থাকেন। ৬ মে ট্যানারি বটতল এলাকায় ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে ঘুরতে থাকেন তিনি। এলাকার একটি সেলুনে বাবুল ফরাজীর ছবি দেখিয়ে নিশ্চত হন ওই এলাকাতেই তাঁরা আছেন। খুঁজে খুঁজে বাবুলের বোনের বাসাও চিনে নেন। এরপর বায়েজিদ বোস্তামী থানায় গিয়ে বিষয়টি জানান।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মঈন উদ্দিন বলেন, ৭ মে ভোরে একটি বাসা থেকে কিশোরীটিকে উদ্ধার করেন তাঁরা। গ্রেপ্তার করা হয় বাবুল ফরাজীকে। পরে বাগেরহাট থানার পুলিশ এসে তাঁদের নিয়ে যায়।
গতকাল সোমবার বিকেলে তাওহীদা প্রথম আলোকে বলেন, নিজের ভাগনি বলে নয়, কিশোরীকে মায়ের বুকে ফিরিয়ে দিতে পেরেই তাঁর আনন্দ হচ্ছে। তিনি বলেন, ছুটি নিয়ে ১ মে চট্টগ্রামে আসার পর প্রথমে পুলিশের সহকারী এক কমিশনারের (ফোর্স) সঙ্গে দেখা করে সহযোগিতা চান তিনি।
তাওহীদার দুঃসাহসিক এই অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মো. আবদুল ওয়ারীশ গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারকের হাত থেকে কিশোরীকে রক্ষা করতে খুলনা থেকে চট্টগ্রাম ছুটে আসা, আবার ছয় থেকে সাত দিন ভিক্ষুক, স্বামী পরিত্যক্তার ছদ্মবেশে অলিগলি বস্তিতে ঘোরা রীতিমতো দুঃসাহসিক কাজ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাওহীদা বুদ্ধি ও সাহসের সঙ্গে এই কাজ করেছেন। তিনি অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।