বাবা ছেলেসহ বিজয়ী প্রার্থীর ৩ সমর্থককে কুপিয়ে হত্যা

ঢাকার দোহারের হাজারবিঘা গ্রামে গতকাল নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় প্রতিপক্ষের হামলায় গুরুতর আহত হন আমেনা বেগম। মিটফোর্ড হাসপাতালে তাঁর পাশে উদ্বিগ্ন স্বজনেরা  ছবি: প্রথম আলো
ঢাকার দোহারের হাজারবিঘা গ্রামে গতকাল নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় প্রতিপক্ষের হামলায় গুরুতর আহত হন আমেনা বেগম। মিটফোর্ড হাসপাতালে তাঁর পাশে উদ্বিগ্ন স্বজনেরা ছবি: প্রথম আলো

ভোট গ্রহণের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই কুপিয়ে খুন করা হলো বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থক বাবা-ছেলেসহ তিনজনকে। গতকাল সোমবার সকালে ঢাকার দোহার উপজেলার হাজারবিঘা গ্রামে প্রতিপক্ষের হামলায় তাঁরা খুন হন।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার বিলাশপুর ইউনিয়নের হাজারবিঘা গ্রামের মোকসেদ খন্দকার ওরফে মুসা খন্দকার (৫৫), তাঁর ছেলে মাসুদ খন্দকার (২৫) ও একই গ্রামের মকবুল হোসেন (৩৫)। তাঁরা ঢাকা-১ আসনে (দোহার-নবাবগঞ্জ) জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে বিজয়ী প্রার্থী সালমা ইসলামের সমর্থক। আর তাঁদের ওপর হামলা চালান আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে পরাজিত প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী আব্দুল মান্নান খানের সমর্থকেরা। এতে সালমা ইসলামের আরও অন্তত ২০ জন সমর্থক আহত হন। তাঁদের মধ্যে এক নারীসহ ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল এবং দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
হামলার শিকার ও হামলাকারী উভয় পক্ষই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থক। তবে এ নির্বাচনে একটি পক্ষ জাতীয় পার্টির সালমাকে সমর্থন দেয়। হামলার শিকার ব্যক্তিরা বিলাশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও দোহার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আলাউদ্দিন মোল্লার পক্ষের লোক। নিহত মকবুল দোহার থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি ছিলেন। তিনি আলাউদ্দিনের ভাগনে। হামলাকারীদের মধ্যে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হুকুম আলী ও তাঁর সহযোগীরা ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁরা আব্দুল মান্নান খানের সমর্থক।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, রোববার সালমা জয়ী হলে আলাউদ্দিনের পক্ষের লোকজন রাতেই এলাকায় বিজয় মিছিল করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হুকুম আলীর নেতৃত্বে মিছিলকারীদের পাল্টা ধাওয়া করা হয়। এর জের ধরে গতকাল সকালে মকবুলের নেতৃত্বে কয়েকজন ব্যক্তি হুকুম আলীর ছেলের শ্বশুরবাড়ি হাজারবিঘা গ্রামে মন্নু শেখের বাড়িতে যান এবং মান্নান খানের কয়েকজন সমর্থককে খুঁজে বাড়ি ফেরেন। খবর পেয়ে দোহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলামসহ পুলিশের সদস্যরা ওই এলাকায় যান। পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুকুম আলী ও তাঁর লোকজন মকবুলসহ অন্যদের ওপর হামলা চালান।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের অভিযোগ, হুকুম আলীর পক্ষের লোকজন ভোটকেন্দ্রেও তাঁদের হত্যার হুমকি দিয়েছিল।
সালমার সমর্থক আলাউদ্দিন মোল্লা অভিযোগ করেন, হামলাকারীদের নির্দেশদাতা ছিলেন আব্দুল মান্নান খানের ভাই মোতালেব খান। দোহার থানার ওসিসহ পুলিশের কয়েকজন সদস্যের উপস্থিতিতে একজনকে হত্যা করা হয়।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে আব্দুল মান্নান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা কোনো রাজনৈতিক বিরোধ নয়। এ বিরোধ স্থানীয় বংশানুক্রমিক চর দখল ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জের।’ ‘এখানে তো আপনার ভাই ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে’ প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত একটি মহল বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তবে এ ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।’
ঘটনার পর পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি সাধারণ মানুষের চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় টহল জোরদার করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত ব্যক্তিদের স্বজন, স্থানীয় লোকজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল সকাল নয়টার দিকে মান্নানের সমর্থক হুকুম আলীর নেতৃত্বে দেড় শতাধিক লোক দুই ভাগ হয়ে মকবুল ও মোকসেদের বাড়িতে হামলা চালান। প্রত্যেকের হাতে ছিল লাঠিসোঁটা, রামদা, চাপাতি, হকিস্টিক, টেঁটা ও বল্লম। হামলাকারীরা বাড়ির সামনে মকবুলকে লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। টেনেহিঁচড়ে সেখান থেকে কয়েক গজ দূরে একটি বাঁশঝাড়ের নিচে নিয়ে তাঁকে এলোপাতাড়ি কোপানো হয়। এতে তিনি গুরুতর জখম হন।
মোকসেদও নিজের বাড়ির সামনে হামলার শিকার হন। হামলাকারীরা তাঁকেও চাপাতি দিয়ে মাথা, পেট, হাতসহ শরীরের প্রায় সব জায়গায় এলোপাতাড়ি কোপায়। চিৎকার শুনে তাঁর ছেলে মাসুদ ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে মারধর থেকে রক্ষার চেষ্টা চালান। মাসুদকেও কোপায় হামলাকারীরা। এ তিনজনকে কোপানোর সময় চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে আশপাশের স্বজনেরা ছুটে এলে তাঁদের ওপরও হামলা চালানো হয়। এতে আহত হন মোকসেদের বোন বছিরুন্নেছাসহ ২০ জন।
প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে এ ঘটনা। হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর স্বজন ও স্থানীয় লোকজন আহত ব্যক্তিদের দোহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মোকসেদ, মাসুদ ও মকবুলকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত তিনজনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে মাতম। মকবুলের বাড়ির কয়েক গজ দূরে বাঁশঝাড়ের নিচে ও কয়েকটি বাঁশে ছোপ ছোপ রক্ত দেখা যায়। তাঁর বাড়ির প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে মোকসেদের বাড়ি। সেখানে যেতে পথে পথেই দেখা যায় ছোপ ছোপ রক্ত। বাড়ির সামনেও বেশ কয়েক জায়গাও রক্তের দাগ দেখা যায় ।
নিহত মকবুলের বোন ফাহিমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকালে বাড়ির সামনে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন মকবুল। কয়েকজন আইসা আমার ভাইরে মাইরা টাইনা বাঁশঝাড়ের নিচে নিয়া যায়। চাপাতি উঠাইয়া আমাদের ভয় দেখাইলে আমরা দৌড়াইয়া বাসার ভেতরে ঢুইকা যাই। পরে দেখি, আমার ভাই রক্ত নিয়া পইড়া আছে।’
নিহত মোকসেদের ভাই দেলোয়ার খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাড়ির সামনে দু-তিন দিক দিয়া হুকুম আলীর লোকজন আমার ভাইসহ অন্যদের ওপর হামলে পড়ে।’
নিহত মকবুলের বাড়ির সামনের আলাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ওসির উপস্থিতিতে তাঁর ভাগনেসহ গ্রামবাসীর ওপর হামলা হয়েছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য ওসিকে প্রত্যাহার করতে হবে।
ওই সময় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান জেলা প্রশাসক ইউসুফ হারুন, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন দোহার থানার ওসি কামরুলও। তাঁদের উপস্থিতিতে মকবুলের স্বজন ও স্থানীয় লোকজনও ওসিকে প্রত্যাহারের দাবি জানান। তাঁরা মান্নান খানের ভাই মোতালেব খান, হুকুম আলীসহ তাঁর সহযোগীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ওসি কামরুল ‘ব্যস্ত আছি’ বলে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি একই কথা বলেন।
যোগাযোগ করা হলে এসপি হাবিবুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশের সামনে ঘটনা ঘটেনি। ওসি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। ঘটনাস্থল থেকে তাৎক্ষণিক তিনজনকে আটক করেছেন তিনি।’
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, হামলার পর হুকুম আলীর সহযোগী আনোয়ার হোসেন (৩১), খোকন (২২) ও তোতা মিয়া (৩৫) এবং বিকেলে নিহত মোকসেদের সৎভাই আলী খন্দকারকে আটক করে পুলিশ।
হুকুম আলীসহ তাঁর স্বজনদের বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে দু-তিন কিলোমিটার দূরে। তাঁরা বাড়িঘরে তালা দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। হুকুম আলীসহ কয়েকজনের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।