দিনাজপুরে ১৫০ বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর, আগুন

ভোট দেওয়ার কারণে দিনাজপুর সদর উপজেলার চেহেলগাজী ইউনিয়নের কর্ণাই গ্রামের ছয়টি পাড়ায় হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা দেড় শতাধিক ঘর ও দোকান পুড়িয়ে দিয়েছেন। রোববার ভোট দিয়ে ঘরে ফেরার পরপরই এ হামলা হয়। সঙ্গে চলে লুটপাট। করা হয় মারধরও।
জেলা প্রশাসক আহমদ শামীম আল রাজী ও পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমীন গতকাল সোমবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
গতকাল দুপুর ১২টায় চেহেলগাজীর কর্ণাই বাজারে গেলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের প্রমাণ মেলে। এলাকার সমাজসেবী মো. রেজাউল করিম জানান, বাজারের সঙ্গে লাগোয়া কর্ণাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ছিল ভোটকেন্দ্র। ভোটারের সংখ্যা সাড়ে চার হাজার, বেশির ভাগই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। রোববার সকাল থেকেই তাঁরা ওই কেন্দ্রে ভোট দেন। তাঁরা বাড়ি ফেরার পর বেলা আড়াইটার দিকে পাশের কাঁটাপাড়া, ডুমুরতলী, মহাদেবপুর, বকরীপাড়া ও কর্ণাই গ্রাম থেকে দুই থেকে আড়াই হাজার সশস্ত্র লোক এসে প্রীতম পাড়া, মাধবপাড়া, অজয়পাড়া, তেলীপাড়া, সাহাপাড়া ও হরিশ পাড়ায় আক্রমণ চালান। পরে কর্ণাই বাজারে শতাধিক দোকানে লুটপাট-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, হামলায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য নাজির আহমেদ ছাড়াও ডুমুরতলী, কাঁটাপাড়া, মহাদেবপুর, বকরীপাড়া ও কর্ণাই গ্রামের আকবর আলী, মাহবুবুল আলম, সাহাবুল আলম, আবুল কানা, নুহু মিঞাসহ অন্যরা নেতৃত্ব দেন। তাঁরা সবাই বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থক।
হামলার শিকার পল্লিচিকিৎসক লিটন রায় বলেন, তাঁর ওষুধের দোকান থেকে ২০ হাজার টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়া, আসবাব ভাঙচুর করা এবং ওষুধ বাইরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ী বিষ্ণু রায় ও জগৎ রায় জানান, তাঁদের দোকানে কম্পিউটার, স্ক্যানার, ফটোকপি মেশিন, নগদ টাকা লুটের পর দোকানঘর ভেঙে দেন হামলাকারীরা।
ব্যবসায়ী সত্যেন রায়ের হোটেল ও প্রমোদের কাঁচামালের দোকান লুট শেষে হামলাকারীরা আগুন ধরিয়ে দেন। স্যালন ব্যবসায়ী সুজন শীল বলেন, তাঁর দোকানের চেয়ার, আয়না, টিভিসহ পুরো ঘরটি তাঁরা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। হামলার সময় আতঙ্কে মানুষ বাজার ছেড়ে পালিয়ে যান। পালিয়ে যান ভোটকেন্দ্রটির প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ অন্যরা।
এ বাজারের পাশেই কর্ণাই হাজীপাড়া। পাড়ার গৃহবধূ পারুল বেগম, রেজিয়া বেগম, খোদেজা বেগম, মজিবর রহমান ও আতাবুদ্দিন—এই পাঁচজনের বাড়িও গুঁড়িয়ে দিয়েছেন হামলাকারীরা। পারুল বেগম জানান, তাঁদের ‘অপরাধ’, তাঁরা সবাই ভোট দিতে গিয়েছিলেন।
তেলীপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, মণিকা রায়, প্রতিমা রায়, পাতানী বালা, জয় বালা, সুচিত্রা বালা, মালতী বালা, চন্দনা বালা, তুলসী বালা, কান্দ বালাসহ ১৫-২০ জন গৃহবধূ ও তাঁদের স্বামী-সন্তানদের হাতে ব্যাগ, মাথায় কাপড়ের পোঁটলা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে ভিটামাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। এ সময় ঘটনাস্থলে আসেন সাংসদ ইকবালুর রহিম। তাঁকে পেয়ে আরও অনেকে জড়ো হয়ে কাঁদতে শুরু করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আক্রমণের সময় এ পাড়ার অনেকেই বিভিন্ন বাঁশঝাড় ও নদীর ধারে লুকিয়ে ছিলেন। পঞ্চম শ্রেণীর এক ছাত্র জানায়, রোববার দুপুর থেকে তাদের পাড়ার কারও মুখে ভাত জোটেনি। গৌরী বালা নামের এক মায়ের কোল থেকে নামছে না তাঁর চার বছরের কন্যাশিশু স্বর্ণ। শুধু কাঁদছে। গৌরী জানান, হামলাকারীদের হাতে ছোরা, হাঁসুয়া আর মারধরের দৃশ্য দেখার পর থেকে আতঙ্কে স্বর্ণ কেঁদেই চলেছে।
প্রীতম পাড়ার অনন্ত চন্দ্র রায় বলেন, ‘স্যার, ভোট আইলে হামার ওপর নির্যাতন নামি আসে। কুনো দিন কি এর প্রতিকার হবে নায়? কেমন করি দেশত থাকিমো।’
ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিমা বালা বলেন, ‘ভোটের আগের রাইতত ওরা বাড়িত আসি ভোট দিবা মানা করি গেইছিল।’
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হামলাকারীরা তাঁদের বাড়ি-জমিতে কাজও করেন। তাঁরা বিএনপি-জামায়াত করেন।
স্থানীয় মহিলা কাউন্সিলর অপর্ণা রায় বলেন, আক্রমণের সময় অনেক পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে দূরে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি আশ্রয় নেন।
দিনাজপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান জেসমিন আরা বলেন, তাঁর পরিবারের সদস্যরা খিচুড়ি রান্না করে হামলার শিকার ব্যক্তিদের সাধ্যমতো খাওয়াচ্ছেন।
দিনাজপুর সদর-৩ আসনের সাংসদ ইকবালুর রহিম বলেন, হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার এবং এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।