আগামী নির্বাচনের জন্য ধৈর্য ধরতে হবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সহিংসতা পরিহার করুন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করুন— বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রতি এই আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত জঙ্গিবাদী জামায়াত-শিবির বিএনপির ঘাড়ে চেপে থাকবে, ততক্ষণ তারা সুস্থ চিন্তাভাবনা করতে পারবে না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
গতকাল সোমবার গণভবনের লনে নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ এবং ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দল ও সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন তিনি। এর আগে গণভবনে আরেকটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন।
মধ্যবর্তী নির্বাচন প্রসঙ্গ: সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা আলোচনার কথা বললেও মধ্যবর্তী নির্বাচন বা পরবর্তী নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা করেই সমাধান করা যাবে। সে জন্য ধৈর্য ধরতে হবে, সহনশীল হতে হবে এবং সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে হবে।
‘আগামী নির্বাচন নিয়ে আপনি আলোচনার কথা বলেছেন, তাহলে কি খুব শিগগির মধ্যবর্তী নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছেন? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বলেছি, আগামী নির্বাচন। আগামী যখনই আসবে, নির্বাচন হবে। আলোচনার উদ্যোগ আমিই বারবার নিয়েছি। টেলিফোন করেছি। বিএনপির নেত্রী সেটা মানেননি। ওনার অবস্থাটা কী দাঁড়াল? উনি তো একূল-ওকূল দুকূল হারিয়ে বসে আছেন। তার পরও আমরা জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সবার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই। তবে এটা নির্ভর করে বিএনপির নেত্রীর ওপর। আগামীতে যে সংসদ বসবে, সেখানে তো উনি বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে বসতে পারছেন না।’
পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বিদেশি সাংবাদিকেরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, খালেদা জিয়া যখন বিরোধীদলীয় নেত্রী থাকবেন না, তখন তাঁর নিরাপত্তাব্যবস্থা কী হবে? জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিয়ম অনুযায়ী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি নিরাপত্তাসুবিধা পাবেন।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘উনি ভালো আছেন। গলফ খেলছেন। অসুস্থ হয়েছেন, চিকিৎসা চলছে।’
নির্বাচন সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কিছু ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়েছে। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছেন। তিনি বলেন, ওরা সন্ত্রাসী কার্যক্রম করেছে। লাদেন স্টাইলে ভিডিওবার্তা দিয়ে নির্বাচন যেতে নিষেধ করা হলেও জনগণ সাড়া দেয়নি।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বলেন, ‘এ নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ উঠতে পারে না। জনগণের ভোটে আমরা নির্বাচিত হয়েছি। সরকার গঠন করে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। যারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তাদের জন্য কারা কাঁদছে, তা আমি জানি না।’ তিনি বলেন, এ নির্বাচনে জনগণ সন্ত্রাস ও নাশকতার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক ধারা ও গণতন্ত্রের পক্ষে রায় দিয়েছে। এ নির্বাচনে গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। পরাজয় হয়েছে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির।
নতুন সরকারের প্রথম কাজ হবে, যেকোনো মূল্যে জনগণের জানমাল এবং রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষা করা। এ কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনোত্তর যেকোনো সন্ত্রাস ও সহিংসতা কঠোরভাবে দমন করা হবে। প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আন্তরিকভাবে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনবিরোধী দুষ্কৃতকারীদের অগ্নিসংযোগে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো অতিসত্বর মেরামত করে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করা হবে। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানার উৎপাদন এবং রপ্তানি-বাণিজ্যকে সব রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাত থেকে রক্ষার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবন সুনিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
হতাহতদের আর্থিক সহায়তা: শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস ও নাশকতার শিকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আহত ও নিহত সদস্যদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। সন্ত্রাসের শিকার হয়ে যেসব সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারকেও সহায়তা করা হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়া হবে। আহতদের চিকিৎসাসেবা অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারকাজ চলবে এবং রায় কার্যকর করা হবে। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে হাইকোর্ট জঙ্গিবাদী সংগঠন হিসেবে রায় দিয়েছেন। তাদের নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে একটা রিট আছে। এটা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে পারি না।’
দাতাগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে পারে কি না, জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অবরোধ আসবে কেন? বাংলাদেশ কী অপরাধ করেছে? বহু দেশে তো এর চেয়েও খারাপ নির্বাচন হয়েছে। আমরা তো সেটা দেখেছি। সেগুলো তো গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এখানে জনগণ বিরোধী দলের বাধা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।’
হলফনামা প্রসঙ্গ: হলফনামায় কিছু মন্ত্রী ও সাংসদের অস্বাভাবিক সম্পদ থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে দুর্নীতিগ্রস্তদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের পাঁচ বছরে দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে গেছে। সবার আয় বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার কমিয়েছি। তবে আয় বাড়ার ধারাবাহিকতা থাকে। কেউ যদি অস্বাভাবিক আয় বাড়িয়ে থাকে, অবশ্যই দুদক ব্যবস্থা নিতে পারবে।’ তিনি বলেন, ‘সংবাদপত্র যাঁর বিরুদ্ধে সংবাদ ছেপেছে, তিনিই সেটার মোকাবিলা করবেন। যদি তিনি মোকাবিলা করতে পারেন ভালো, না পারলে তার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। দুর্নীতিকে কখনোই প্রশ্রয় দেব না।’
সরকার গঠন সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধভাবেই দেশ পরিচালনা করব। জোটের সঙ্গে কথা বলব। সব দল এলে তাদের নিয়েও করতে পারি। আমার কোনো আপত্তি থাকবে না। আমি চাই মিলেমিশে দেশটার উন্নতি করি। তবে বিরোধী দলও থাকতে হবে।’ ভোটের হার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জনগণ যে ভোট দিতে পেরেছে, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। যতটুকু দিয়েছে ততটুকুই যথেষ্ট।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার পরিচালনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচিত হয়েছি। অবশ্যই আর্থসামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্পন্ন করব। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। উজানে নাও ঠেলে যাওয়া—এটাই তো আমাদের কাজ। আমরা সেটাই করে যাচ্ছি।’