নতুন আইনে সংকটে পড়বে দেশীয় শিল্প

.
.

নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক আইন বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হলে সংকটে পড়বে দেশীয় শিল্প। আগামী ১ জুলাই থেকে সরকার এই আইন বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, যেখানে অল্প কিছু পণ্যে সম্পূরক শুল্ক থাকার কথা বলা হয়েছে। ফলে আমদানি পর্যায়ে যেসব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক আছে, তার বেশির ভাগের ওপর এ শুল্ক থাকবে না। এতে ওই সব পণ্য আমদানি খরচ কমবে, দেশে ওই সব পণ্য উৎপাদনকারীদের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে।
মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনটি প্রায় চার বছর আগে সংসদে পাস করা হলেও এত দিন সম্পূরক শুল্কের প্রভাব নিয়ে ব্যবসায়ীরা তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। আইনটি বাস্তবায়নের আগে শেষ মুহূর্তে অর্থাৎ কয়েক মাস ধরে ব্যবসায়ীরা তাঁদের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। তাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এখন তাড়াহুড়ো করে দেশি শিল্প সুরক্ষায় পুরো ট্যারিফ লাইন পুনর্মূল্যায়ন করছে। নতুন আইনে ১৭০টি পণ্যে সম্পূরক শুল্ক থাকার কথা। এনবিআর কর্মকর্তারা এখন প্রাথমিকভাবে ৫০০-এর মতো পণ্য বাছাই করেছেন, যেখানে সম্পূরক শুল্ক বসানো যেতে পারে।
নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে সরকার আরও দুটি পরিবর্তন আনছে। ১৫ শতাংশ মূসক হার নিয়ে সরকারের অনড় অবস্থানের পরিবর্তন হচ্ছে। আবার ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখার টার্নওভার সীমাও বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ভ্যাট হার কত হবে এবং ভ্যাটমুক্ত সীমা কত হবে—এই দুটি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন। এনবিআরকে ভ্যাট হার কমানো হলে কী পরিমাণ রাজস্ব কমবে, এর একটি বিশ্লেষণ দিতে বলা হয়েছে। এনবিআর এ নিয়ে কাজ করছে। ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্নওভার বা লেনদেনে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোনো ভ্যাট আদায় না করার কথা বলা ছিল। এ লেনদেন সীমা বাড়িয়ে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত করা হতে পারে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।
আজ বৃহস্পতিবার এবং আগামী ১৪ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাজেট নিয়ে বৈঠক হবে। সেই বৈঠকেই ভ্যাট নিয়ে মূল দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে বলে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে।
এনবিআর সূত্রমতে, ১০-১২ শতাংশ মূসক হার ধরেই রাজস্ব আদায়ের বিশ্লেষণ চলছে। যে হারই চূড়ান্ত হোক না কেন, ভ্যাটের মূল দর্শন অনুযায়ী হার হবে অভিন্ন। এর মানে, ভ্যাটের একটি হারই থাকবে। এখনকার মতো পণ্য বা সেবাভেদে ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাট হার থাকবে না।
মূসক হার কমানোর ইঙ্গিত দিয়ে গতকাল বুধবার এনবিআরের এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘নতুন ভ্যাট আইন কিছুটা সংশোধন করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের জন্য একটি স্বস্তিদায়ক ভ্যাট হার দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তবে কত হবে সেটা বলতে পারব না।’ ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দাতাদের খুশি করার জন্য নতুন ভ্যাট আইন হচ্ছে—এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী শুধু বলেন, ‘রাবিশ।’
সম্পূরক শুল্ক: নতুন আইনের দ্বিতীয় তফসিলে সম্পূরক শুল্ক আরোপযোগ্য ১৭০টি পণ্য ও সেবার একটি তালিকা আছে। বর্তমান আইনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ পণ্যে সম্পূরক শুল্ক আরোপ আছে। কোনো পণ্যের আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হলে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা পায়। স্থানীয় বাজারে দেশীয় উদ্যোক্তারা যাতে টিকে থাকতে পারেন, সে জন্য একই পণ্য আমদানি করা হলে এর আমদানি খরচ বৃদ্ধি করা হয় সম্পূরক শুল্ক আরোপের মাধ্যমে।
সম্পূরক শুল্ক উঠে গেলে কোন কোন খাত বিপাকে পড়বে, এর একটি তালিকা করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)। বিল্ড বলছে, সিরামিক, প্লাস্টিক, পাদুকা, সাবান, বস্ত্র, টিস্যু, দেশীয় বাজারমুখী তৈরি পোশাক, খাদ্যশিল্প, ইস্পাত শিল্প, কাচ উৎপাদনকারী কারখানাসহ ৩০টি শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এসব পণ্য আমদানিতে এখন ১০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আছে। এসব পণ্যের বাজার এখন দেশি উদ্যোক্তাদের দখলে। আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক উঠে গেলে দেশি উদ্যোক্তারা দামের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন।
এখন জুতা আমদানিতে সম্পূরক শুল্কের হার ৪৫ শতাংশ। এক জোড়া জুতার আমদানি মূল্য যদি ২ হাজার টাকা হয়, তাহলে এর ওপর ১ হাজার ১২৫ টাকা সম্পূরক শুল্ক বসে। আমদানি মূল্য ও আমদানি শুল্ক আরোপের পর সম্পূরক শুল্ক বসে। নতুন আইনে জুতা আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক না থাকায় আমদানিকারককে এই ১ হাজার ১২৫ টাকা দিতে হবে না। এর ফলে বিদেশ থেকে আমদানিতে খরচ ব্যাপকভাবে কমে যাবে।
সম্পূরক শুল্ক উঠে গেলে বিপাকে পড়বে দেশীয় সিরামিক। বাংলাদেশ সিরামিক পণ্য প্রস্তুতকারী সমিতি (বিসিডব্লিউএমএ) বাজেট প্রস্তাবে বলেছে, সিরামিকের স্যানিটারিওয়্যার ও তৈজসপত্র আমদানিতে ৬০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা হলে এর দাম ২৩ থেকে ২৯ শতাংশ কমে যাবে। নতুন আইন অনুযায়ী, সিরামিক টাইলস ৯ শতাংশ কম শুল্ক দিয়ে আমদানি হবে এবং এতে দেশি টাইলসের দাম বিদেশি টাইলসের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি হবে। বিসিডব্লিউএমএর হিসাব অনুযায়ী, সিরামিক শিল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। ৪৭টি প্রতিষ্ঠান পণ্যভেদে চাহিদার ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ উৎপাদন করে।
বর্তমানে প্লাস্টিকের বিভিন্ন তৈজসপত্র ও গৃহস্থালি সামগ্রীর ওপর আমদানিতে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আছে। এই শুল্ক না থাকলে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ভারত থেকে প্লাস্টিক পণ্য আমদানি বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন ৮০ শতাংশ পণ্য দেশে উৎপাদন করি। সুরক্ষা কমলে এ বাজার বিদেশি সিরামিকস পণ্যের দখলে যাবে।’ বিপিজিএমইএর তথ্যমতে, সারা দেশে ২ হাজার ৯৯৭টি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে।
বিল্ডের তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আছে এমন পণ্যগুলো হলো পাদুকা, তৈরি পোশাক, বিস্কুট, কেক ও রুটি, আলু, কাচ, রড ও লৌহজাত পণ্য। ২০-৩০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আছে এমন পণ্য হলো সাবান, লবণ, মশার কয়েল, প্লাস্টিকের পাইপ ও অন্যান্য ফিটিংস, সিল্কের কাপড়, টমেটো কেচআপ ও সস, রং, টয়লেট পেপার ও ফেসিয়াল টিস্যু, ধরনভেদে কাচ ও লৌহজাত পণ্য, লোহা ও ইস্পাতের তৈজসপত্র ও স্যানিটারিওয়্যার, রেজর ও ব্লেড, বৈদ্যুতিক সুইচ ও আসবাব এবং এর যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। এসব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের বাজেট প্রস্তাব হলো, দেশি শিল্প সুরক্ষায় সেখানে বিদ্যমান আইনের তফসিলে আমদানি পর্যায়ে যেসব পণ্যের সম্পূরক শুল্ক আছে, সেগুলো বহাল রাখা।