বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সম্মুখভাগে আঘাত

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ধারাসহ ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ধারা ও উপধারাসহ ১১টি বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন উচ্চ আদালত। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, এই ১১টি বিধানই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সম্মুখভাবে আঘাত। এই রায়ের ফলে ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যাবে না বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও বিচারকাজ পরিচালনার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা পৃথক তিনটি রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে বলা হয়, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ধারা ৫, ৬ (১), ৬ (২), ৬ (৪), ৭, ৮ (১), ৯, ১০,১১, ১৩ ও ১৫ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং ধারাগুলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে (নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগ) ক্ষমতার পৃথক্‌করণ-সংক্রান্ত সংবিধানের দুটি মৌলিক কাঠামোর বিরোধী। অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা ও বিতর্ক এড়াতে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ হওয়া বিষয়গুলো ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেওয়া সব আদেশ, সাজা ও দণ্ডাদেশ অতীত বিবেচনায় সমাপ্ত বলে মার্জনা করা হয়েছে।

ঘোষিত রায়ে বলা হয়, আইনের ওই বিধানের মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া সংবিধানের লঙ্ঘন এবং তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় সম্মুখ আঘাত এবং ক্ষমতার পৃথক্‌করণের নীতিবিরোধী। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেটসহ বাংলাদেশ কর্মকমিশনের সব সদস্যরা (প্রশাসন) প্রশাসনিক নির্বাহী। প্রশাসনিক নির্বাহী হিসেবে তারা প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌম বিচারিক ক্ষমতা চর্চা করতে পারেন না, কেননা মাসদার হোসেন মামলায় রায়ে এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। আরও বলা হয়, ৫, ৬ (১), ৬ (২), ৬ (৪), ৭, ৮ (১), ৯, ১০,১১ ও ১৩ ‘কালারেবল প্রবিশন’। ধারাগুলো সরাসরি মাসদার হোসেন মামলার রায়ের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

দুটি পৃথক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছয় বছর আগে এবং অপর একটির পরিপ্রেক্ষিতে পাঁচ বছর আগে এ বিষয়ে রুল হয়েছিল। রুলে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ধারা ৫,৬ (১), ৬ (২), ৬ (৪), ৭, ৮ (১), ৯, ১০,১১, ১৩,১৫ কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। পৃথক রুলের ওপর একসঙ্গে গত ৮ মার্চ শুনানি শেষ হয়। সেদিন আদালত আবেদনগুলো রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন, এরপর আজ রুল যথাযথ (অ্যাবসলিউট) ঘোষণা করে রায় দেন আদালত।

ওই আইনের ৫ ধারায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিষয়ে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ৬ (১), ৬ (২), ৬ (৪), ৭, ৮ (১), ৯, ১০ ধারায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা পদ্ধতি, ১১ ধারায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়া ক্ষমতা, ১৩ ধারায় আপিল ও ১৫ ধারায় তফসিল সংশোধনে সরকারকে দেওয়া ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে।

রায় ঘোষণার পর তিন রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী হাসান এম এস আজিম প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সালের ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের ১১টি বিধান অসাংবিধান ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ফলে ওই আইনের মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে এখন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যাবে না। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হলে এখন সংবিধান ও মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে আইন নতুন করে আইন করতে হবে। তিনি বলেন, রায়ে একই সঙ্গে রিট আবেদনকারী দুই ব্যক্তিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেওয়া সাজা ও জরিমানার আদেশ অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১০ লাখ টাকা জরিমানার অর্থ ৯০ দিনের মধ্যে আবেদনকারী মজিবুর রহমানকে ফেরত দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে জানান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্যে ভেজাল, কাপড়ে রং মেশানো ও পরীক্ষার হলে নকল করাসহ দৃশ্যমান কিছু অপরাধ আছে, যেসব ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের তফসিলে এমন ১০০টি আইনের অপরাধের কথা রয়েছে, যার বিচার ও দণ্ড দেওয়া যেতো। হাইকোর্টের রায়ের ফলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। তবে ওই ধরনের কোনো অপরাধ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দৃষ্টিগোচর হলে তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে থানায় সোপর্দ করতে পারবেন।

রায়ে বলা হয়, এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে সংসদের করা আইনের তফসিল এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেবল একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের তফসিল সংশোধন করতে সরকার কেন এবং কীভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলো, তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। কোনো আইন সংশোধনের ক্ষমতা প্রধানত সংসদের। ওই আইনের তফসিল সংশোধনের ১৫ ধারা বলে সংসদ সেই ক্ষমতা সরকারের অনুকূলে দিয়েছে। সংসদ আইনের অধীন বিধিবিধান তৈরির ক্ষমতা সরকার বা অন্য কর্তৃপক্ষের অনুকূলে দিতে পারে। কিন্তু সংসদ মূল সংবিধি সংশোধনে তার যে প্রধান ক্ষমতা, তা কাউকে দিতে পারে না। আইনের ১৫ ধারাবলে এই আইনের তফসিল সংশোধনের ক্ষমতা হস্তান্তর করে সংসদ নিঃসন্দেহে ক্ষমতা পৃথক্‌করণের ধারণাকে লঙ্ঘন করেছে। ক্ষমতার পৃথক্‌করণ আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ।

পৃথক তিন রিট
মামলা সূত্রে জানা যায়, ভবন নির্মাণ আইনের কয়েকটি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এসথেটিক প্রপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান খানকে ভ্রাম্যমাণ আদালত ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। সে বছরের ২০ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান তিনি। এরপর ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের (মোবাইল কোর্ট অ্যাক্ট-২০০৯) কয়েকটি ধারা ও উপধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ১১ অক্টোবর কামারুজ্জামান হাইকোর্টে রিট করেন। শুনানি নিয়ে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল দেন। রুলে রিট আবেদনকারীর (কামরুজ্জামান) সাজা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি সাজার আদেশ স্থগিত করা হয়।

ভবন নির্মাণ আইনের কয়েকটি ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০১১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর টয়েনবি সার্কুলার রোডে অবস্থিত একটি বহুতল ভবনের মালিক মো. মজিবুর রহমানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আইনের বিধান ও অর্থ ফেরতের নির্দেশনা চেয়ে ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর রিট করেন মজিবুর। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে সেদিন হাইকোর্ট রুলসহ সাজার আদেশ স্থগিত করেন।

এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত আইনের কয়েকটি বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালে ২ মে দিনাজপুরের বেকারি মালিকদের পক্ষে মো. সাইফুল্লাহসহ ১৭ জন অপর রিটটি করেন। এতে বেকারিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষেত্রে খাদ্য বিশেষজ্ঞ ও পরীক্ষার জন্য যন্ত্রপাতি সঙ্গে রেখে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চাওয়া হয়। শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৮ মে হাইকোর্ট রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেন।