আসামির বাবাও বিচার চান, তবু গা ছাড়া পুলিশ

পুত্রবধূ হত্যার জন্য নিজের ছেলের দিকেই আঙুল তুললেন আমিরুল হক। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের বিচারও চান। নিহত নারীর বাবার অভিযোগ, একমাত্র আসামি আরিফুল হক পুলিশকে প্রভাবিত করে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হচ্ছেন। পুলিশ যথারীতি অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

গত ২৪ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার চর চারতলা গ্রামে শ্বশুরবাড়ির পরিত্যক্ত পানির ট্যাংক থেকে কামরুন্নাহারের (২৮) হাত-মুখ বাঁধা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি ছিলেন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর তিন বছরের একটি মেয়েও আছে। কামরুন্নাহারের লাশ উদ্ধারের পর থেকে স্বামী আরিফুল হক পলাতক।

গত মঙ্গলবার এ ঘটনার সর্বশেষ অবস্থা জানতে সরেজমিনে যান এই প্রতিবেদক। কামরুন্নাহারের বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি পাশাপাশি। বাড়িটি ‘খান বাহাদুর সরকার বাড়ি’ নামে পরিচিত। বাড়ির সামনে মোটর সাইকেল রেখে ভেতরে যান প্রতিবেদক। ফিরে এসে দেখেন, কিছু যন্ত্রাংশ নষ্ট করে মোটরসাইকেলটি অচল করে দেওয়া হয়েছে।

কামরুন্নাহার ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাস করেন। আরিফুল হক এসএসসির গণ্ডি পেরোননি। সম্পর্কে তাঁরা চাচাতো ভাই-বোন। কামরুন্নাহার বাবার একমাত্র সন্তান। বাবার বিপুল সম্পত্তির ৭৫ ভাগ তাঁর নামে ছিল। ওই সম্পত্তি কাল হয়ে দাঁড়ায় কামরুন্নাহারের জন্য।

পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সম্পত্তির লোভে কিছুটা কৌশল আর কিছুটা জোর করে কামরুন্নাহারকে বিয়ে করেন আরিফুল। পাঁচ বছর আগে ২০১২ সালে এই বিয়ে হয়। কামরুন্নাহারের বাবা মফিজুল হক বলেন, ‘আমার মেয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসত। কিন্তু আরিফুল ও তাঁর চাচাতো ভাই এ কে আবদুল্লাহ ওরফে প্রদীপ বিভিন্নভাবে প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দিত। অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিলে আমার সম্পত্তি অন্যের কাছে চলে যাবে বলে একপর্যায়ে ভাই আমিরুল হকসহ আমার অন্য ভাইয়েরা আরিফুলের সঙ্গে কামরুন্নাহারকে বিয়ে দিতে চাপ দেন। আমার স্ত্রীর অসুস্থতার কথা চিন্তা করে শেষে আমি রাজি হই।’

মফিজুল হক জানান, কিছুদিন ধরে আরিফুল সব সম্পত্তি তাঁর নামে লিখে দেওয়ার জন্য কামরুন্নাহারকে চাপ দিচ্ছিলেন। কামরুন্নাহার তাতে রাজি হচ্ছিলেন না। এই সম্পত্তির জন্যই আরিফুল তাঁকে হত্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগে আরিফুলকে আসামি করে আশুগঞ্জ থানায় মামলা করেছি। কিন্তু আরিফুলের লোকজন টাকা দিয়ে পুলিশকে প্রভাবিত করছে। এ জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।’

জামাতাকে সন্দেহ করার আর কোনো কারণ আছে কি না জানতে চাইলে মফিজুল হক বলেন, ঘটনার দিন সকালে আরিফুল তাঁকে এসে বলেন, কামরুন্নাহারকে পাওয়া যাচ্ছে না। এই বলে আরিফুল আশুগঞ্জ বাজারে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে (চাতাল) চলে যান। তিনি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কামরুন্নাহারের সন্ধান পাচ্ছিলেন না। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বাড়ির পরিত্যক্ত পানির ট্যাংকের ভেতরে হাত বাঁধা, মুখে পলিথিন মোড়ানো ও গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় কামরুন্নাহারের লাশ পাওয়া যায়।

আসামি আরিফুলের বাবা আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘হেরা (কামরুন্নাহার ও আরিফুল) এক রুমে থাহে। ওই রুমে ডাকাত, ছিনতাইকারী বা অন্য কেউ আইয়্যা মাইরা থাকলে আমার ছেলেও তো আহত অইত। হয় নাই। এর দায় আমার ছেলে এড়াইতে পারত না।’

এখন তিন কক্ষের একটি টিনশেড বাসায় একা থাকেন কামরুন্নাহারের বাবা মফিজুল হক। উঠানের পূর্ব দিকে কামরুন্নাহারের শ্বশুরের ঘর। মফিজুল হকের স্ত্রী নাসরিন হক ২০১৫ সালে মারা যান। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে তিনি এখন পাগলপ্রায়। মেয়ের কথা বলতে গিয়ে তাঁর চোখ ভিজে যায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এখন কেউ নেই। মেয়ের হত্যাকারীরা আমাকে মেরে ফেলবে। যেকোনোভাবেই তারা তা করবে। আমি মরে গেলে কেইসটা (মামলা) বন্ধ হয়ে যাবে।’

আসামি আরিফুলের বাবাও মনে করছেন, তাঁর ভাই বাদী মফিজুল হক নিরাপত্তাহীনতায় আছেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তা (ওসি) ইদ্রিস মিয়া বলেন, আরিফুলসহ কয়েকজনের মুঠোফোনের কলের তালিকা এখনো হাতে আসেনি। একবার তাঁর অবস্থান ঢাকায় শনাক্ত হয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবার হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ প্রভাবিত হচ্ছে বিষয়টি সঠিক নয়। আসামি পলাতক থাকায় গ্রেপ্তার করতে সময় লাগছে।