পুলিশ বলল গণপিটুনি, সিআইডির তদন্তে পরিকল্পিত খুন

প্রথমে বেধড়ক পেটানো হয় লোহার রড দিয়ে। এরপর ছুরিকাঘাত। এতেও ক্ষান্ত হননি খুনিরা। মাথার পেছনে হকিস্টিক দিয়ে জখম করে কেটে দেয় পায়ের গোড়ালি। তারপরও মৃত্যু নিশ্চিত করতে করা হয় গুলি। একজন নিরস্ত্র-নিরীহ ব্যক্তিকে এমনই নৃশংসভাবে হত্যা করেন খুনিরা। তাঁর নাম মাহবুব আলম। বাড়ি রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর এলাকায়। ইসলামপুর থেকে তিন কিলোমিটার দূরের ঠান্ডাছড়ি এলাকায় একটি খামার বাড়িতে ২ বছর ৮ মাস আগে লোমহর্ষক এ ঘটনা ঘটেছিল।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে উঠে আসে খুনের এই ইতিবৃত্ত। অথচ রাঙ্গুনিয়া থানার পুলিশ চার মাস তদন্ত শেষে দিয়েছিল চূড়ান্ত প্রতিবেদন। পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডকে বলেছিল গণপিটুনি।

দুই বছর চার মাস তদন্ত শেষে ১৬ জনকে আসামি করে চলতি বছরের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। ১৭ মে আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে ১৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। অন্য দুজন জামিনে আছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল্লাহ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, কাঠ ও বালু ব্যবসার বিরোধের জেরে মাহবুবকে পরিকল্পিতভাবে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ঠান্ডাছড়ি এলাকায় ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করা হয়। অভিযোগপত্রে সহিদুল ইসলাম, আনিছুল ইসলাম, মো. এরশাদসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়। তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও মারামারির মামলা রয়েছে। দুই আসামি ছাড়া বাকিরা পলাতক রয়েছেন।

২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুরে গলাচিপা এলাকার বাড়ির পাশের একটি চায়ের দোকান থেকে মাহবুব আলমকে দুপুরে তুলে নিয়ে যায় একদল দুর্বৃত্ত। একই দিন বিকেলে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের ঠান্ডাছড়ি এলাকার একটি চা-বাগানের পাশ থেকে তাঁকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তির স্ত্রী মোরশেদা বেগম বাদী হয়ে ছয় দিন পর ২২ নভেম্বর রাঙ্গুনিয়া থানায় মামলা করেন।

হত্যাকাণ্ডের পর ৪ মাস তদন্ত শেষে রাঙ্গুনিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শুভ রঞ্জন চাকমা পরের বছরের ৬ মার্চ চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, পুলিশ তদন্ত শেষে মাহবুব গণপিটুনিতে মারা গেছেন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেলেও কে বা কারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন, তা উদ্‌ঘাটন করা না যাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলো।

 পুলিশের দেওয়া এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করেন বাদী। ২০১৫ সালের ৮ জুন আদালত সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক মো. হোসাইন খান। তিনি বদলি হলে পরিদর্শক জসীম উদ্দিন খান তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। পরে তিনি বদলি হলে পরিদর্শক আবদুল্লাহ ভূঁইয়া তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দেন আদালতে।

সিআইডির দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ঘটনাস্থলের পাশের লোকজন ঘটনা জানা সত্ত্বেও আসামিদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। বাদী ও সাক্ষীরা আতঙ্কে রয়েছেন। আরও উল্লেখ করা হয়, হত্যাকাণ্ডের আগে আসামিরা সবাই মিলে বিরিয়ানি খান। এরপর হত্যাকাণ্ড শুরু করেন। এতে অংশ নেন ১৬ আসামি।

মামলার বাদী ও নিহতের স্ত্রী মোরশেদা বেগম বলেন, পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিলেও সিআইডি ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে। আসামিরা সন্ত্রাসী হওয়ায় প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকেন। তিনি স্বামী হত্যার বিচার চান।