মা হারানোর শোক চেপে ব্রবিশি পেল জিপিএ-৫

এসএসসি পরীক্ষার দ্বিতীয় দিন মা হারায় ব্রবিশি। সেই শোক নিয়ে পরীক্ষা দিয়েও সে পেয়েছে জিপিএ-৫ l প্রথম আলো
এসএসসি পরীক্ষার দ্বিতীয় দিন মা হারায় ব্রবিশি। সেই শোক নিয়ে পরীক্ষা দিয়েও সে পেয়েছে জিপিএ-৫ l প্রথম আলো

সেদিন সকালে মা নিজ হাতে তাকে খাইয়ে দিয়েছিল। সেই খাবার খেয়ে এসএসসি পরীক্ষাও দিতে গেছে ব্রবিশি দাশ (১৬)। কিন্তু পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে বের হয়েই তাকে যেতে হয় থানায়। সেখানে নিথর পড়ে থাকতে দেখে মাকে। ব্রবিশিকে জানানো হয়, খুন হয়েছে তার মা। এসএসসি পরীক্ষার শুরুর দিকে এমন নির্মম বাস্তবতার মাঝে পড়েও ভেঙে পড়েনি সে। সব হারানোর শোক নিয়েই বসতে হয়েছে পড়ার টেবিলে। এরপর শোককে শক্তিতে পরিণত করে পেয়েছে জিপিএ-৫।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি আনোয়ারা উপজেলার পরৈকোড়া ইউনিয়নের শিলালিয়া গ্রামে ব্রবিশির দাদার বাড়িতে খুন হন তার মা ঊর্মি দাশ (৩৮)। ঘটনার পর থেকেই তার বাবা আশীষ দাশ (৫০) ও দাদি সুখী দাশ পলাতক। এ ঘটনার পর আনোয়ারা থানায় মামলা করেছেন ব্রবিশির মামা শ্রীধাম বিশ্বাস।

উপজেলার মাহাতা পাটনীকোঠা উচ্চবিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ব্রবিশি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এ বছর। মায়ের মৃত্যুর দিন ছিল বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা। পটিয়ায় নানার বাড়িতে মায়ের শেষকৃত্য শেষে সে চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় খালার বাড়িতে চলে যায়। শোক নিয়ে সেখান থেকেই বাকি পরীক্ষাগুলোয় অংশ নেয়। ২১ মে বিকেলে চট্টগ্রাম শহরের কালুরঘাট মৌলভীবাজার এলাকায় খালার বাসায় কথা হয় তার সঙ্গে।

 ব্রবিশি দাশ প্রথম আলোকে বলে, ‘৫ ফেব্রুয়ারি ছিল আমার বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা। পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল হাইলধর বশিরুজ্জমান স্মৃতি শিক্ষাকেন্দ্র। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে মা নিজেই আমাকে খাইয়ে দেন। এরপর মা-বাবা দুজন আমাকে কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য গাড়িতেও তুলে দেন। কিন্তু পরীক্ষা শেষে আত্মীয়স্বজনেরা আমাকে থানায় নিয়ে মায়ের লাশ দেখান। ওই সময় আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এসব কী করে হলো, কেন হলো, কিছুই বোঝার শক্তি ছিল না।’

আনোয়ারা থানা সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার পরৈকোড়া ইউনিয়নের শিলালিয়া গ্রামের নারায়ণ দাশের ছেলে আশীষ দাশের সঙ্গে ১৭ বছর আগে বিয়ে হয় পটিয়ার হাইদগাঁওয়ের নিতাই বিশ্বাসের মেয়ে ঊর্মি দাশের। তাঁদের সংসারে তিন ছেলেমেয়ে। আশীষ দাশ চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লায় সাইনবোর্ড ও ব্যানার লেখার কাজ করতেন। তবে নিয়মিত স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণের খরচ দিতেন না বলে অভিযোগ আছে। এ নিয়ে প্রায়ই কথা-কাটাকাটি ও ঝগড়া হতো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। সন্তানের পড়াশোনার খরচ মেটাতে দুই বছর আগে ঊর্মি চট্টগ্রামের একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেন। থাকতেন ছোট বোন কুমকুম বিশ্বাসের কালুরঘাটের বাসায়।

ঊর্মির আত্মীয়স্বজনেরা অভিযোগ করেন, গত ২ ফেব্রুয়ারি বড় ছেলে ব্রবিশির এসএসসি পরীক্ষা উপলক্ষে পরৈকোড়ার শিলালিয়ায় যান ঊর্মি দাশ। আর ৫ ফেব্রুয়ারি সকালে ছেলে পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়ার পর স্বামী ও শাশুড়ির হাতে তিনি খুন হন। ঘটনার পর আশীষ দাশ পালিয়ে গেলে এই দম্পতির তিন সন্তানের ঠাঁই হয় ঊর্মির বোন কুমকুম বিশ্বাসের কাছে। সেখানে থেকে ব্রবিশি এসএসসি পরীক্ষার অন্যান্য বিষয়ে অংশ নেয়। ব্রবিশির ছোট বোন পূজা দাশ (১৪) নবম শ্রেণিতে ও ভাই দেবরাজ দাশ (৯) চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে।

মায়ের শেষকৃত্য ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ফাঁকেই ব্রবিশিকে ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা দিতে হয়েছে। এরপরও কীভাবে জিপিএ-৫ পেয়েছে জানতে চাইলে সে বলে, ‘হয়তো মায়ের আশীর্বাদ ছিল। মা প্রায়ই বলতেন, আমি যেন ভালো কলেজে ভর্তি হই। মায়ের স্বপ্ন ছিল আমাকে ব্যাংকার হিসেবে দেখার।’

ব্রবিশির মামা ও মামলার বাদী শ্রীধাম বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার দুই আসামি আশীষ দাশ ও সুখী দাশকে এখনো পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। আমরা চাই তাঁদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক।’

এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঊর্মি দাশ খুন হওয়ার পর অভিযুক্ত আশীষ দাশ ও সুখী দাশ পালিয়ে যান। আমরা আসামিদের ধরার জন্য কয়েকবার অভিযান চালিয়েছি। এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

জীবনে কঠিন বাস্তবতাকে জয় করে ব্রবিশি যেভাবে ভালো ফলাফল করেছে, তাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছেন আনোয়ারা থানার এই পুলিশ কর্মকর্তা। মা–হারা কিশোরের এই সাফল্যে আনন্দিত পরৈকোড়ার বাসিন্দারাও।

ব্রবিশির খালা কুমকুম বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্তানদের মানুষ করার আশায় আমার বোন শহরে এসে চাকরি নেয়। তার ছেলে ভালো ফলাফল করেছে। আজ সে বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতো।’