জাপাকে নিলে সরকারের ধরন হবে 'অভিনব'


আগামী রোববার শপথ নিতে যাওয়া নতুন সরকারের কাঠামো বা বৈশিষ্ট্য কেমন হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা হচ্ছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় জাতীয় পার্টি (জাপা) জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। কিন্তু দলটি একই সঙ্গে সরকারেও থাকতে চায়। এ নিয়ে জাপার নেতারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে দেনদরবার করছেন।
জাপার নেতারা মন্ত্রিসভায় যোগ দিলে জাতীয় সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল থাকবে না। ফলে এক ‘অভিনব সরকার ও সংসদ’ প্রতিষ্ঠা হতে পারে বলে রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল মনে করছে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, দশম সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগ এবার ‘জাতীয় ঐকমত্যের’ সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সরকারে দশম সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসা অন্যান্য দলের প্রতিনিধি থাকবেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাপার নেতারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা সংসদে বিরোধী দলে থাকার পাশাপাশি সরকারেও যোগ দেওয়ার ইচ্ছার কথা জানান। তবে তাঁদেরকে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রী জাপার নেতাদের বলেছেন, দুই দিন সময় আছে, এ বিষয়ে আরও আলোচনা হবে।
এই অবস্থায় জাপাকে সরকারে নেওয়া হলে জাতীয় সংসদের বিরোধী দল কারা থাকবে, তা নিয়ে ভাবনায় পড়েছে আওয়ামী লীগ। গত সোমবার নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি মহাজোটে আছে। তবে সংসদে বিরোধী দলও রাখতে হবে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেন, জাপাকে একই সঙ্গে বিরোধী দল ও সরকারে রাখার বিষয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে তীব্র আপত্তি রয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপি সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও দেশের একটি বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে থেকে যাচ্ছে। ফলে সরকারবিরোধী আন্দোলন বা বড় রকমের কর্মসূচির সম্ভাবনা থাকায় সরকার সব সময় চাপে থাকবে। এ কারণে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শিগগিরই কাটছে না।
সরকার গঠনে প্রস্তুতি: আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, নতুন সরকার গঠনের জন্য শেখ হাসিনা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে মন্ত্রিসভায় কারা থাকছেন, সে ব্যাপারে কাউকে এখনো তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে তিনি অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের মন্ত্রিসভায় নিতে পারেন। বর্তমান সরকারে থাকা যেসব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির অভিযোগ আছে, তাঁদের নতুন মন্ত্রিসভায় নেওয়া হবে না বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, আগামী বাজেট পর্যন্ত আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকবেন। এ ছাড়া দলীয় নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ওবায়দুল কাদের, নুরুল ইসলাম নাহিদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের হাসানুল হক ইনু নতুন মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে।
‘মডেল’ বিরোধী দল হতে চায় জাপা: জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সরকারেও থাকতে ইচ্ছুক জাপার নবনির্বাচিত সাংসদেরা। এর জন্য দলের প্রভাবশালী কয়েকজন সাংসদ সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছেন।
যদিও জাপার চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ সাংসদ হিসেবে শপথ নিতে ইতিমধ্যে সরকারকে চারটি শর্ত দিয়েছেন। এর একটি ছিল জাপা থেকে কাউকে মন্ত্রী না করা। এরশাদের ইচ্ছা, জাপা সংসদে কেবল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করুক। তাঁর শর্তগুলো মানলে নির্বাচন বর্জনের পরও তিনি বিরোধীদলীয় নেতা হতেও সম্মত আছেন বলে গত বুধবার সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাঁর দলে সৃষ্ট ‘রওশনপন্থী’ অংশটি তা মানছে না। তারা যুগপৎভাবে সরকার ও বিরোধী দল—উভয় অবস্থানেই থাকতে তৎপর।
সরকারে থাকতে ইচ্ছুক জাপার নতুন সাংসদের যুক্তি হচ্ছে, এবারের নির্বাচন স্বাভাবিক নির্বাচন ছিল না। বিরোধীদলীয় জোট এ নির্বাচন কেবল বয়কট নয়, প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে ব্যাপক সহিংসতা করেছে। এর পরও জাপার প্রার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচন করেছেন। তাই এ সাহসিকতার পুরস্কার হিসেবে নতুন সরকারে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের প্রতিনিধিত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়।
জানতে চাইলে জাপার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ এ দৃষ্টিভঙ্গির কথা স্বীকার করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি, দেশের স্বার্থে এবার একটি জাতীয় ঐকমত্যের সরকার হবে। তাতে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল সব দলের অংশগ্রহণ থাকা যেমন আবশ্যক, তেমনি আমাদের দলেরও প্রতিনিধি থাকা অপরিহার্য বলে মনে করি।’
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এরশাদপত্নী রওশনের নেতৃত্বে জাপার একাংশ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশে অংশ নেয়। তাতে এরশাদসহ ১৩ জন জয়ী হন। এর আগে রওশনসহ দলটির ২০ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতানো হয়। সব মিলিয়ে ৩৩ জন সাংসদ দলটির। এই অবস্থায় দশম সংসদে আওয়ামী লীগের পর জাপাই দ্বিতীয় বৃহত্তম দল।
সংসদে জাপার প্রধান বিরোধী দলের রূপটা কেমন হবে, তা নিয়ে যখন রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছিল, তখন জাপার নবনির্বাচিত সাংসদদের কেউ কেউ বলেছেন, এবার তাঁরা প্রথাগত বিরোধী দলের বাইরে ভিন্ন ধাঁচের বিরোধী দল হতে যাচ্ছেন। জাপার নেতাদের কেউ এটাকে নেলসন ম্যান্ডেলার সরকার, আবার কেউ পাকিস্তানের আসিফ আলী জারদারির নেতৃত্বাধীন বিগত পিপিপি সরকারে প্রধান বিরোধী দল নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগের ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করেন।
অবশ্য, গতকাল শপথ নিয়ে সংসদ ভবন থেকে বের হওয়ার পর জাপার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘সংসদে জাপা একটি মডেল বিরোধী দল হবে।’
দলের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ‘আমরা কথায় কথায় ওয়াকআউট করব না। সংসদে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করব না। বিরোধী দল হিসেবে যতটুকু ভূমিকা রাখা দরকার, জাপা ততটুকুই রাখবে।’
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক: শেখ হাসিনা দশম জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও ছিলেন।
জানা যায়, শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতিকে তাঁর সংসদ নেতা নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করেন। তিনি নতুন সরকার গঠনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা শেখ হাসিনাকে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের জন্য বঙ্গভবন প্রস্তুত বলেও রাষ্ট্রপতি জানিয়েছেন।
বঙ্গভবন থেকে গণভবনে ফেরার পর রাতে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন দশম সংসদের বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ। তাঁরা নতুন সরকার গঠনের বিষয়ে আলোচনা করেন বলে জানা গেছে।