চলে গেলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আর নেই। আজ শনিবার রাতে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
আজ রাতে হাবিবুর রহমানের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে তাঁকে দ্রুত ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরীক্ষা নীরিক্ষার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক শাহীনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ রাত নয়টা ২০ মিনিটে হাবিবুর রহমানের স্বজনেরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তখন আমরা তাঁকে মৃত পাই। তবে প্রায় আধা
ঘণ্টা ধরে আমরা তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাই। শেষমেষ নয়টা ৫৩ মিনিটে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করি।’

হাবিবুর রহমানের স্ত্রী ইসলামা রহমান জানান, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থই ছিলেন। আজানের সময় ঘুম থেকে উঠেছেন। নামাজ পড়ে সকালে হাঁটাহাঁটি করেছেন। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে ছাদে গিয়ে গাড়ির চালককে নিয়ে সেখানে টবে গাছ লাগান। পরে তিনি সন্ধ্যার দিকে চেয়ার-টেবিলে বসে বই পড়েন। আটটার দিকে কয়েকজন পরিচিত লোক তাঁর সঙ্গে এসে কথা বলেন। সোয়া আটটার দিকে ওই লোকদের বিদায় দিয়ে তিনি তাঁর কক্ষে গিয়ে বিবিসির খবর শুনছিলেন। এর ঘন্টাখানিক পরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
হাবিবুর রহমানের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে রুবাবা রহমান ও স্ত্রীকে নিয়ে গুলশান-১ নম্বরের ১২৪ নম্বর রোডের তিন তলা বাসায় থাকতেন তিনি।
তাঁদের অপর দুই মেয়ে নুসরাত হাবিব ও রওনাক শিরিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।
বাসায় দুই গৃহকর্মীও থাকেন।
হাবিবুর রহমানের শ্যালক আলী ইফতিয়ার চৌধুরী বলেন, হাবিবুর রহমানের মেজো মেয়ে নুসরাত হাবিব যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগামী সোমবার ভোরে বাংলাদেশে পৌঁছাবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত লাশ ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হবে। এরপর পরবর্তী কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর রাজধানীর বনানী কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফনের আপাতত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত বদলাতে পারে।

সংক্ষিপ্ত জীবনী
উইকিপিডিয়া জানায়, ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুর মহকুমার দয়ারামপুর গ্রামে মুহম্মদ হাবিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন৷ বাবা মৌলভী জহিরউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন আইনজীবী৷ জহিরউদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। তিনি প্রথমে আঞ্জুমান এবং পরে মুসলিম লীগ আন্দোলনের সাংগঠনিক পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন৷ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হাবিবুর রহমানের পিতা জাতীয় যুদ্ধ ফ্রন্টের বিভাগীয় নেতা ছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকার ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে বহরমপুর কারাগারে পাঠায়, অবশ্য কয়েকদিন পরই জহিরউদ্দিন বিশ্বাস মুক্তি লাভ করেন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে মুশির্দাবাদ ছেড়ে জহিরউদ্দিন বিশ্বাস রাজশাহীতে চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন৷ হাবিবুর রহমানের মা গুল হাবিবা ছিলেন গৃহিণী৷
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে ১৯৪৯ সালে বিএ সম্মান ও ১৯৫১ সালে এমএ পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইতিহাসে ১৯৫৮ সালে বিএ সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
হাবিবুর রহমান তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়ে। এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে তিনি ইতিহাসের রিডার (১৯৬২-৬৪) ও আইন বিভাগের ডিন (১৯৬১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি আইন ব্যবসাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেন। তিনি সহকারী অ্যাডভোকেট জেনারেল (১৯৬৯), হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট (১৯৭২) ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলেরও (১৯৭২) সদস্য ছিলেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি ১৯৯৫ পর্যন্ত আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।। ১৯৯০-৯১ মেয়াদে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করলে হাবিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ সালে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
১৯৯৫ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হিসেবে তিনি ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তথা দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।