শুধু চার কিলোমিটার অংশ গলার কাঁটা

ঢাকা–সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া মার্কেটের কাছে চলছে উড়ালসড়কের কাজ। নির্মাণযজ্ঞ, সড়ক সরু হয়ে যাওয়া এবং যানবাহনের চাপে তীব্র যানজট এখন নিত্যদিনের ব্যাপার, যা আসন্ন ঈদে ঘরমুখী মানুষের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছবিটি গতকাল নারায়ণগঞ্জের ভুলতা এলাকা থেকে তোলা l হাসান রাজা
ঢাকা–সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া মার্কেটের কাছে চলছে উড়ালসড়কের কাজ। নির্মাণযজ্ঞ, সড়ক সরু হয়ে যাওয়া এবং যানবাহনের চাপে তীব্র যানজট এখন নিত্যদিনের ব্যাপার, যা আসন্ন ঈদে ঘরমুখী মানুষের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছবিটি গতকাল নারায়ণগঞ্জের ভুলতা এলাকা থেকে তোলা l হাসান রাজা

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যাতায়াত কঠিন করে তুলেছে মাত্র চার কিলোমিটার অংশ। এর মধ্যে এক কিলোমিটার পথ হচ্ছে মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের নিচে যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত। বাকি তিন কিলোমিটার দুর্ভোগের নাম নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া মার্কেট এলাকা। যানজট, খানাখন্দ আর সড়কের ওপর নির্মাণযজ্ঞের ফলে এই পথের যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতরে ঘরমুখী মানুষের যাত্রাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিতে পারে।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে চলতে গেলে ঘরমুখী মানুষ কী ঝামেলা ও ভোগান্তিতে পড়তে পারেন, তা দেখার জন্য এই প্রতিবেদক এবং একজন ফটোসাংবাদিক গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে আটটার দিকে গাড়িতে কারওয়ান বাজার থেকে রওনা দেন। ওই দুই স্থানের ঝক্কি পাড়ি দিয়ে নরসিংদীর মাধবদী পৌঁছাতে চার ঘণ্টা লাগে। এই পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে আসতে সময় লেগেছে প্রায় ছয় ঘণ্টা। এই পথে আসা-যাওয়ার দূরত্ব বড়জোর ১০০ কিলোমিটার। এতেই সময় লাগল সব মিলিয়ে প্রায় ১০ ঘণ্টা।

সড়কপথে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার মূল পথ ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। এই পথে মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের নিচের দুই-তৃতীয়াংশ এখন নালায় পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সড়ক সম্প্রসারণের কাজের জন্য এমনটা হয়েছে। যানবাহন চলাচলের জন্য যেটুকু পথ আছে, তাতেও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এই সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেরও প্রবেশ বা বহির্মুখ। তবে উড়ালসড়কের ডেমরা সড়ক দিয়েও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ওঠা যায়। তবে পুরোনো এই সড়ক অপেক্ষাকৃত সরু এবং স্থানে স্থানে যানজট হয়।

নারায়ণগঞ্জের ভুলতার গাউছিয়া মার্কেটের কাছে উড়ালসড়ক নির্মাণের কাজ চলছে দুই বছর ধরে। ফলে গাউছিয়া মার্কেটের আগে-পরের ১০ কিলোমিটার এলাকায় তীব্র যানজট নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ওঠার জন্য মহাখালী থেকে টঙ্গী-ঘোড়াশাল হয়ে আরেকটি সরু সড়ক আছে, যেটি নরসিংদীর পাঁচদোনায় গিয়ে মহাসড়কে মিশেছে। ওই সড়কেরও কিছু স্থানে বড় বড় গর্তের কারণে চলাচল দায় হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে ঢাকা থেকে সিলেট পথে দৈনিক প্রায় ৫০০ বাস চলাচল করে। ঈদযাত্রায় তা আরও বেড়ে যায়।

সকাল নয়টার দিকে মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের নিচ দিয়ে যাত্রাবাড়ী মোড়ে পৌঁছে দেখা গেল, যাওয়ার পথটি বন্ধ। আসার পথটি চালু আছে। তবে ধীরগতিতে লাফিয়ে লাফিয়ে যান চলছে। ডেমরা সড়ক ধরে কিছু যান আসতে পারছে। কিন্তু যেতে পারছে না। উড়ালসড়কের নিচের সড়ক সম্প্রসারণের কাজ চলছে কয়েক মাস ধরে। ফলে আসা-যাওয়ার দুই দিকেই সড়কের দুই-তৃতীয়াংশে গভীর গর্ত, পানি জমে আছে। যান চলাচলের জন্য যে অংশটুকু উন্মুক্ত, তাতে স্থানে স্থানে বড় গর্ত। কাঁচপুর সেতুর দিকে যাওয়ার পথটি তাই সকালে বন্ধ করে মেরামতকাজ চলছিল।

আমাদের গাড়িটি যাত্রাবাড়ী থেকে দোলাইরপাড় হয়ে খালের পাশ দিয়ে সরু সড়ক ধরে কুতুবখালীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে উঠে অপর পাশে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পরে যানজট ঠেলে সায়েদাবাদ দিয়ে হানিফ উড়ালসড়কে উঠতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় চলে যায়।

উড়ালসড়ক ধরে গাড়ি চলতে শুরু করার পর কাঁচপুর সেতু পার হয়ে ৪০ মিনিটের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় পৌঁছে যায়। এরপর আবার যানজটে পড়তে হয়। চালক জানালেন, এখান থেকেই ভুলতা উড়ালসড়কের যানজট শুরু।

মহাসড়কের দুই পাশে ভুলতা এলাকার গাউছিয়ায় গড়ে উঠেছে অন্যতম বড় কাপড়ের বাজার। ঢাকাকে বাদ দিয়ে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের যোগাযোগের একটি সড়ক (যা ঢাকা বাইপাস নামে পরিচিত) ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ওপর দিয়ে আড়াআড়ি গেছে। গাউছিয়ায় হাট বসে সোম ও মঙ্গলবার। এই দুই দিন যানজট হয়। যানজট নিরসনে ২৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি উড়ালসড়ক নির্মাণে ২০১৫ সালের অক্টোবরে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। দুই বছরের মধ্যে শেষ করার কথা থাকলেও এখনো অর্ধেক কাজই হয়নি।

উড়ালসড়কটির দৈর্ঘ্য এক কিলোমিটারের কিছু বেশি। মাঝখানে বেড়া দিয়ে কাজ চলছে। দুই প্রান্তে আরও দুই কিলোমিটার সড়ক সম্প্রসারণের কাজ চলছে। ফলে বিদ্যমান পথটি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু স্থানে গর্ত হয়ে গেছে। এমনিতে যানবাহনের চাপ, এর ওপর কিছু বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করা হয়। ফলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

স্থানীয় ফ্লেক্সিলোডের ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ রায় বলেন, সোম ও মঙ্গলবার হাটের দিন যানজট বেশি হয়। বৃহস্পতিবার পাশের গোলাকান্দিয়াইলে পশুর হাট বসে, সেদিনও জট বেড়ে যায়।

স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার রাতে ১০০ মিটার পথ উল্টো ঘুরে আসতে তাঁর এক ঘণ্টা লাগে। গাউছিয়া মার্কেটের সামনে মনোহরদী পরিবহনের চালক বেলাল হোসেন বলেন, কখনো কখনো গাউছিয়া মার্কেটের দুই প্রান্তে ১০ কিলোমিটার বা এরও বেশি দূর পর্যন্ত যানজট হয়। গাড়ি নিয়ে উড়ালসড়ক নির্মাণের স্থানটি পার হতে এই প্রতিবেদকের লেগেছে প্রায় দেড় ঘণ্টা। এরপর মাধবদী পর্যন্ত কোনো যানজট বা ঝক্কি পোহাতে হয়নি। সব মিলিয়ে সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাছান প্রথম আলোকে বলেন, এই পথে যানজট পুরোনো। এটা নিরসনের জন্যই উড়ালসড়ক। ঈদে প্রয়োজনে নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হবে। ভোগান্তি যাতে কম হয়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বেলা দুইটার দিকে মাধবদী থেকে ফিরতি যাত্রা শুরু হয়। পুনরায় গাউছিয়ার কাছাকাছি এসে যানজটে পড়তে হয়। এবার আগের চেয়েও প্রকট, আসা-যাওয়ার দুই পথেই অসংখ্য যান আটকে আছে। এর মধ্যে শুরু হয় বৃষ্টি। একপর্যায়ে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় বরপা এসে গাড়ি গতি পায়। কাঁচপুর সেতু ও চিটাগাং রোড সহজেই পাড়ি দিয়ে গাড়ি মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে ওঠে। তখন ঘড়িতে সময় বিকেল সোয়া পাঁচটা। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। চানখাঁরপুল এসে যখন গাড়ি উড়ালসড়ক থেকে নামে, তখন ঘড়িতে সময় সন্ধ্যা ৬টা ২৫। উড়ালসড়কেই পার হয়ে যায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট। গাড়িচালক মো. ঝুটন বলেন, ‘নিচের সড়ক খারাপ। কিন্তু ওপরেও তো যানজটের অশান্তি।’

জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন প্রথম আলোকে বলেন, উড়ালসড়কের নিচের সড়কটির দুরবস্থা সাত-আট বছর ধরেই। এবার তাঁরা ১৩০ কোটি টাকায় সড়ক সম্প্রসারণ, নালা ও ফুটপাত নির্মাণসহ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছেন। কাজ শুরু হয়েছে মাস তিনেক আগে। কিন্তু এবার আগে বর্ষা শুরু হওয়ার কারণে কাজটা গোছানো যায়নি। দুর্ভোগ স্বচক্ষে দেখেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঈদে কোনো রকমে সচল রাখার জন্য এক লাখ ইট এনেছি। কয়েক শ শ্রমিক নিয়োগ করেছি। এটা প্রকল্পের বাইরে।’