রোহিতপুরে তাঁত নেই, লুঙ্গি আছে

মোহাম্মদ আলীর তাঁতযন্ত্রের সামনে তাঁতি ওয়াজউদ্দিন মুন্সি
মোহাম্মদ আলীর তাঁতযন্ত্রের সামনে তাঁতি ওয়াজউদ্দিন মুন্সি

একদিন বাবুরহাট বাজারে গামছা কিনতে গেছেন ওয়াজউদ্দিন মুন্সি। বেশ খাসা রং। এই গামছা কোন জায়গার? দামদরের আগে জানতে চান তিনি। বিক্রেতা বলেন, ‘রোহিতপুরের গামছা।’

‘কী! রোহিতপুরের কোন জায়গায় এই গামছা তৈরি হয়?’

‘ভুল বলেছি নাকি?’ গর্জে ওঠেন বিক্রেতা।

ওয়াজউদ্দিন মুন্সির বাড়ি রোহিতপুরে। বংশপরম্পরায় তাঁরা তাঁতি। শেষে ওই বিক্রেতা ক্ষমা চান, স্বীকার করেন এই গামছা রোহিতপুরের নয়।

রোহিতপুরের নারায়ণপট্টিতে বাড়ির দাওয়ায় বসে গল্পটি বলছিলেন ওয়াজউদ্দিন মুন্সি। একসময় তাঁর তিনটি তাঁত ছিল।

মজার ব্যাপার হলো, এখানে তাঁত তেমন না থাকলেও বাজারে রোহিতপুরি লুঙ্গি-গামছার অভাব নেই। তাহলে?

কেরানীগঞ্জের কদমতলী থেকে সাত কিলোমিটার দূরত্বে রোহিতপুর ইউনিয়ন। এই বাজারে বেশ কিছু লুঙ্গি-গামছার পাইকারি দোকান। সব ‘আদি রোহিতপুরি’।

রামেরকান্দা সড়কের মুখের এই গ্রাম দিয়েই শুরু হওয়ার কথা তাঁত অঞ্চল। কিন্তু ঈদের এই সময়েও তাঁতের খুটখাট শব্দ নেই। পথে দেখা পাওয়া বৃদ্ধ হাসাবুদ্দিন বললেন, ‘এই এলাকায় তো কোনো তাঁত এখন নেই। তবু যান নারায়ণপট্টি; যদি দেখা মেলে একটা বা দুইটা।’

নারায়ণপট্টি এসে তাঁতব্যবসায়ী লতিফ ব্যাপারীর খোঁজ করতেই দেখা মেলে ওয়াজউদ্দিন মুন্সির। তিনি বলেন, এখানে তাঁত বা তাঁতি নেই। অবশেষে তিনি নিয়ে যান মোহাম্মদ আলীর বাড়িতে, যিনি একজন কারিগর।

মোহাম্মদ আলী বাড়িতে নেই। দুই দিন ধরে তাঁতে বসেন না। খানিকটা দূর থেকে তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘রাজের জোগালি (রাজমিস্ত্রির সহকারী) দিতে গেছে।’ তাঁতযন্ত্রটি তো দেখা যাবে? ভেতর থেকে উত্তর এল, ‘যাবে।’

তাঁতঘরে ঢুকে ওয়াজউদ্দিন মুন্সি যেন ফিরে যান যৌবনে, ‘এই জিনিসটার নাম মাজন। এটা দিয়ে সুতা মাড় দেওয়া ও ধারালো করা হয়। মাজন বিক্রি হতো শ্রীরামপুর বাজারে (সিরাজদিখান উপজেলা)। আর এই যন্ত্রটার নাম ডগগি। এটা দিয়ে লুঙ্গির পাড়ের নকশি (নকশা) করা হয়।’

এখানকার প্রবীণ তাঁতিদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, রোহিতপুরের (শব্দটি রুহিতপুরও লেখা হয়) তাঁতের ঐতিহ্য প্রায় শত বছরের। আড়াই-তিন হাজার তাঁত ছিল কেবল এই রামেরকান্দা, নারায়ণপট্টিতে। আর এখান থেকে উৎপাদিত তাঁতপণ্যের বাজার বসত রোহিতপুরে। তাঁতি, পাইকার, ফড়িয়ারা মুখর করে রাখতেন বাজারটি। ভারত, সৌদি আরব, দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় কদর ছিল রোহিতপুরি লুঙ্গির। হ্যান্ডলুমে তৈরি হওয়ায় লুঙ্গি খুব মিহি হতো।

এখন এখানে তাঁতি আছেন বড়জোর ১০-১২ জন। তাঁরা বানান সাদা লুঙ্গি।

কেন এমন হলো? এবার যোগ দেন ওয়াজউদ্দিন মুন্সির সহোদর মোবারক হোসেন। ১৭টি তাঁতের মালিক ছিলেন। এখন নারায়ণপট্টিতে দোকান দিয়ে বসেছেন। নাম ‘সোনার বাংলা লুঙ্গি’। তাঁদের ভাষ্য, স্বাধীনতার আগে জাপান, কোরিয়া, পাকিস্তান, মিসর, থাইল্যান্ড থেকে সুতা আসত। সেই সুতায় তৈরি হতো লুঙ্গি। এখন বিদেশি সুতা আগের মতো মেলে না। আর দেশি সুতার দাম বেশি। মোবারক যোগ করেন, ‘পাওয়ারলুম (বিদ্যুচ্চালিত তাঁত) দিতে পারলে চলত।’ আলোচনায় যোগ দেন ইদ্রিস আলী। তাঁর কথা সোজাসাপটা, ‘বিদেশি সুতা আসে না। বাংলাদেশি সুতা চলে না।’

তবে তাঁত বন্ধ বলে এই এলাকায় অভাব আছে, ব্যাপারটা সে রকম নয়। এই এলাকার যুবকশ্রেণির বড় অংশই প্রবাসী। ইদ্রিস আলীর কথায়, ‘একেকজনের পোলাপান একেক লাইন ধইরা খাইতাছে।’ মানে, তাঁত প্রজন্মেরও বিলুপ্তি ঘটেছে দু-তিন দশক আগে।

তবে বাজারে এত রোহিতপুরি লুঙ্গি কোথা থেকে আসে? উত্তর হলো, ব্যবসায়ীরা পাবনা, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ), রাজশাহী অঞ্চল থেকে পাওয়ারলুমে তৈরি করা লুঙ্গি কিনে এনে ‘আদি রোহিতপুরি’ ট্যাগ বসিয়ে দেন। এটা শুধু এখানকার ব্যবসায়ীরা করেন তা নয়, অন্য ব্যবসায়ীরাও করেন।

ফেরার পথে রামেরকান্দায় রাস্তার পাশে দেখা যায় একটি ডাইং কারখানা। সুতায় রং দেওয়া চলছে। ‘মাহাজান’ শিশির আহমেদ নিজেও কাজে নেমে পড়েছেন। মিল থেকে সুতা কিনে রং করে তারপর বিক্রি করেন তিনি। ‘তাঁতই তো নেই। তাহলে সুতা বেচেন কার কাছে?’ ‘সুতা বিক্রি হয় সিরাজদিখানের হাটে। মুন্সিগঞ্জ সদর, সিরাজদিখান, ঢাকার দোহারে কিছু তাঁত এখনো আছে। তারা কিনে নেয়।’ শিশিরের নির্লিপ্ত উত্তর।