হাওরপারে নিরানন্দের ঈদ

চারদিকে থইথই পানি। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বসতভিটায়। প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। কারও উঠানে, কারও ঘরে পানি। যোগাযোগে নৌকাই একমাত্র মাধ্যম। এ চিত্র মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের ইসলামপুরসহ কাউয়াদীঘি হাওরপারের গ্রামগুলোয়। হাওরে ফসলহারা এসব গ্রামবাসীর এবার ঈদ কেটেছে নিরানন্দে।

গত সোমবার ঈদুল ফিতরের দিন সকাল সাড়ে নয়টার দিকে ইসলামপুর গ্রামের একটি বাড়ির কাছে এই প্রতিবেদককে বহনকারী নৌকাটিভেড়ে। এ সময় বাড়িটি থেকে বেরিয়ে আসেন ফাতেমা বেগম (৪৫) নামের এক নারী। ঈদ কেমন হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরার কোনো ঈদ নাই। ঘরে ভাত নাই। কাজ নাই। বাইচ্চা-কাইচ্চা লইয়া সকালে শুঁটকির চাটনি দিয়া ঠান্ডা ভাত খাইছি। নতুন একটা জামাও দিতাম পারছি না বাইচ্চাইনতরে। বড় নিরুপায় অবস্থায় আছি। খুব কষ্টে দিন যার।’

পাশের বাড়িতে ভিটার কাছেই পানি আছড়ে পড়ছে। ছোট্ট বারান্দায় মোরগ জবাইয়ের পর মাংস কাটছিলেন মরতুজা বেগম (৪৫)। তিনি বলেন, ‘পানিয়ে ধান পান নিছেগি (নিয়ে নিছে)। কিলা (কেমনে) ঈদ করতাম। তবু গরিবানা ছুরত (গরিবের মতো) ঈদ কররাম। হুরুত্বা হকল (সকল ছেলেমেয়ে) মাংস খাইতো পাগল অই (হয়ে) গেছে। এর লাগি (এর জন্য) মোরগ একটা আনছি।’

এর আগে সকাল নয়টায় ফতেহপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায় অনেক মানুষের জটলা। কেউ কোলাকুলি করছেন, কেউ বাড়ির দিকে ছুটছেন। বাজারের পাশেই ঈদগাহে খানিক আগে ঈদের জামাত শেষ হয়েছে। বাজারের উত্তর পাশে গাছতলায় অর্ধশতাধিক শিশু খেলাধুলা করছে। তাদের প্রায় সবার গায়ে নতুন-পুরোনো রঙিন জামা।

কাশিমপুর গ্রামের আনছার মিয়া বলেন, ‘এবার আমারই ২০/২২ কিয়ার (বিঘা) জমির খেত পানিয়ে নিছে। খুব কষ্টে মানুষ ঈদ করছে। এই যে এত মানুষ দেখছেন। কদিন আগে এলেও দেখতেন না। ধান নষ্ট হওয়ায় অনেকে ঋণ শোধ করতে না পেরে এলাকা ছেড়েছে। অনেকের ঘরে খাবার নেই। ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে যে যা পারছে, তা-ই করছে। ঈদ উপলক্ষে অনেকে বাড়িতে এসেছে। যাদের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই, তাদের তো কাজও নেই।’

এই বাজারে দেখা হয় ইসলামপুর গ্রামের আহাদ মিয়ার (৩০) সঙ্গে। তিনি ছোট নৌকায় করে গ্রামের ভেতরে নিয়ে গেলেন। কাউয়াদীঘি হাওরপারে তাঁর বাড়ি। বসতভিটায় পানি। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। ভিটা রক্ষা করতে কচুরিপানা দিয়ে একটা প্রতিরোধ তৈরির চেষ্টা করেছেন। উঠানের এক পাশে গরু তিনটি রাখা। আরও দেড়-দুই ফুট পানি বাড়লে ঘরের ভেতর পানি চলে আসবে।

ইসলামপুর গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িই এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। প্রতিটি বাড়িতেই ফসল হারানোর টুকরো টুকরো কষ্ট জমা হয়ে আছে। অনেকেই ধার-দেনা করে ঈদ উদ্‌যাপন করেছেন। কেউ কেউ কিছু ধান পেয়েছিলেন। তা বিক্রি করে সন্তানদের জন্য নতুন পোশাক কিনেছেন। কারও বাড়তি যৎসামান্য আয় আছে। তাই দিয়ে চলছেন। এলাকার ওয়াপদা-অন্তেহরি সড়কে গলা সমান পানি। নৌকা ছাড়া চলাচলের উপায় নেই। যাঁদের নৌকা নেই, তাঁরা বাড়িতেই আটকে আছেন। কেউ কেউ কলাগাছের ভেলা বানিয়ে যাওয়া-আসা করছেন।

ইসলামপুর গ্রামের আবদুল আজিজ (২৫) বলেন, ‘১০ কিয়ার জমিতে খেত করছিলাম। উজানে থাকায় দুই-তিন কিয়ারের ধান পাইছি। কিছু ধান বেচি ঋণ দিছি। কিছু খানির লাগি (খাওয়ার জন্য) আছে। কিছু বেচি পরিবারের সবাইরে নতুন জামা দিছি। এবার ধান নিচে পানি ও পাথরে (শিলাবৃষ্টিতে)। খুব কষ্টে দিন যার। এর মাঝে রাস্তাটাও ডুবাইল। তিন মাস ধরি আমরা পানিত।’ তিনি আরও বলেন, এলাকার ইসলামপুর, সোনাপুর ও কাশিমপুর—এই তিনটি গ্রামেই প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস। তাদের সবারই কমবেশি ধান নষ্ট হয়ে গেছে।

গত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে অতিবর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের সঙ্গে মৌলভীবাজার জেলার হাকালুকি, কাউয়াদীঘি, হাইল হাওরসহ ছোট-বড় বিভিন্ন হাওরের বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যায়। এতে জেলার ২০ হাজার ১৯৩ হেক্টর জমির ধান জলাবদ্ধ হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১২ হাজার ৮১৪ হেক্টর জমির ধান। জেলা প্রশাসক মো. তোফায়েল ইসলামের গতকাল বুধবার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ঈদুল ফিতরের আগে ২৯৪ মেট্রিক টন চাল ও ১০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ভিজিএফ কার্ড দেওয়া হয়েছে ৫৯ হাজার ২০০ জনকে। এর আগেও বিভিন্ন পর্যায় তাদের সহায়তা করা হয়।