দখলে অস্তিত্ব হারাচ্ছে 'সেচ খাল'

মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় দখলদারদের থাবায় অস্তিত্ব হারাচ্ছে একমাত্র ‘সেচ খাল’। এ কারণে স্থানীয় পাঁচটি বিলের অন্তত ১০ হাজার একর জমিতে বর্ষায় পানিনিষ্কাশন ও শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানির জোগান নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে।

মহম্মদপুরের কৃষি ও কৃষকের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এ খালটি স্থানীয়ভাবে রামসাগরের খাল নামে পরিচিত। মধুমতী নদীর সঙ্গে যুক্ত খালটি ঘোপ বাঁওড় থেকে কাতলাশুরি বিল পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার।

জানতে চাইলে মহম্মদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা চৌধুরী রওশন ইসলাম গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূমি জরিপে খাল আছে ঠিকই। মূলত হাল মাঠ জরিপের সময় ঘাপলাটা হয়েছে। রেকর্ডে যেখানে খাল দেখানো হয়েছে, সেখানে খালের অস্তিত্ব নেই। আর যেখানে খাল আছে, সেটাকে ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। যে কারণে আমি রেকর্ড সংশোধনের জন্য চেষ্টা করছি। রেকর্ড সংশোধন করা গেলে দখলমুক্ত হয়ে খালটি স্বনামে ও অস্তিত্বে ফিরবে।’

উপজেলা প্রশাসন সূত্র বলছে, সরকারি খাসখতিয়ানভুক্ত খালটির পাড়ের অধিবাসীরা সর্বশেষমাঠ জরিপের সময় ভূমি অফিসের
অসাধু ব্যক্তিদের সহায়তায় খালের অনেক জায়গা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড করে নিয়েছে। এভাবে খাল দখল করে প্রকাশ্যে স্থাপনা নির্মাণ করা হলেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

সরেজমিনে দেখা গেল, মহম্মদপুরের বাঐজানি থেকে আমিনুর রহমান কলেজ এলাকা হয়ে কাজী সালিমা হক মহিলা কলেজের পেছন দিয়ে কাতলাশুরির বিলে পড়েছে খালটি। এসব এলাকায় খালের দুই পাড়ে বহু ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি বাড়িই খালের জায়গার মধ্যে বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। খালের ভেতর থেকে পিলার তুলে সীমানাপ্রাচীরসহ নানা স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।

মহম্মদপুর সদরের কানাইনগর গ্রামের বাসিন্দা সাবেক প্রধান শিক্ষক স্বপন কুমার অধিকারী (৭৫) দুঃখ করে বলেন, শৈশবে তিনি এই খাল ২০ থেকে ২৫ ফুট প্রশস্ত দেখেছেন। এখন কোথাও কোথাও ৩ থেকে ৪ ফুটে এসে ঠেকেছে।

কাজী সালিমা হক মহিলা কলেজ এলাকায় খালের পাড় ও ভেতর মিলে প্রায় ২৫ শতাংশ জমির ওপর বহুতল ভবন নির্মাণের জন্যদেয়াল নির্মাণ করেছেনমজনু শাহ নামের এক ব্যবসায়ী। তবে মজনু শাহ দাবি করেন, খাল দখল করে নয়, খালের পাশে কেনা জমি ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন তিনি।

মহিলা কলেজের এক কর্মচারী খালের মধ্যে প্রায় ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ইটের দেয়াল তুলে মাটি ভরাট করে বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া কলেজ এলাকায় খালের ডান পাড়ে এক ব্যক্তি খালের মধ্যে থেকে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন।

বাঐজানি থেকে কাতলাশুরির বিল পর্যন্ত পুরো এলাকায় খালের দুই পাড়ে শতাধিক জায়গায় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন। খালের জমি ভরাট করে স্থাপনা তৈরি করায় কৃষি ও কৃষকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ সেচ খালটি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। কয়েকটি জায়গায় নাব্যতা হারিয়ে খালের অস্তিত্বই এখন সংকটের মুখে।

স্থানীয় দুজন প্রবীণ কৃষক বলেন, পুরোনো খালটি একসময় ২০ ফুটেরও বেশি প্রশস্ত ছিল। ছিল স্রোতস্বিনী। খাল দিয়ে নৌকা চলত। নৌকায় ফসল আসত কৃষকের ঘরে। এখন খালই নেই।

পাঁচ বিল নিয়ে দুশ্চিন্তা

এলাকার অন্তত পাঁচজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালের মধ্যে অবকাঠামো নির্মাণ করায় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খালের মূলধারা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছে খালের সঙ্গে সংযুক্ত কাতলাশুরি, ধোয়াইল, ফলিয়া, সিন্দাইন ও সূর্যুকুন্ডু বিল। এসব বিলে কমপক্ষে ১০ হাজার একর কৃষিজমি রয়েছে। খাল অস্তিত্ব হারানোয় বর্ষা মৌসুমে এসব বিলে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে; আর শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানি সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে।

শ্যামনগর গ্রামের বাসিন্দা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক সদস্য আবদুর রহমান বলেন, খালটি কৃষি ও কৃষকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দখলের কারণে খালটি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় এ এলাকার কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

কোটি টাকার স্লুইসগেটের কাজ নেই

খালটি মহম্মদপুর সদরের বাঐজানি এলাকা থেকে মধুমতী-নবগঙ্গা সেচ প্রকল্পের (এমএন প্রজেক্ট) মূল খাল থেকে শুরু হয়ে (উত্তর-দক্ষিণে) সদরের বৃহৎ ফসলি মাঠ কাতলাশুরির বিলে গিয়ে পড়েছে। খালের পানি নিয়ন্ত্রণে আশির দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাঐজানি এলাকায় কোটি টাকা ব্যয়ে স্লুইসগেট নির্মাণ করে। দখলে খাল সংকুচিত হওয়ায় সেটি এখন আর কোনো কাজে আসছে না।

মহম্মদপুর সদরের বাসিন্দা ও আমিনুর রহমান ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, খালটি শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, এটি মহম্মদপুরের প্রাণ। দখলের কারণে অস্তিত্ব হুমকিতে পড়েছে। এটি দখলমুক্ত করা একান্ত জরুরি।

মহম্মদপুর সদর ইউপির চেয়ারম্যান আবুল হোসেন মোল্লা বলেন, ‘খালের ভেতরের জমি কোনো ব্যক্তির হতে পারে না। বিষয়টি আমি উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় উত্থাপন করব।’