'তুলে নেওয়ার' ১৮ ঘণ্টা পর উদ্ধার ফরহাদ মজহার

ফরহাদ মজহার
ফরহাদ মজহার

‘অপহরণের’ ১৮ ঘণ্টা পর কবি, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গতকাল সোমরার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাঁকে যশোরের অভয়নগরে একটি বাস থেকে উদ্ধার করা হয়।

গতকাল ভোরে কে বা কারা ফরহাদ মজহারকে রাজধানীর শ্যামলীর হক গার্ডেনের বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন স্বজনেরা।

র‍্যাব-৬-এর পরিচালক খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ ও র‍্যাবের অভিযানের একপর্যায়ে রাত সাড়ে ১১টার দিকে খুলনা থেকে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে যশোরের অভয়নগরের বেঙ্গল টেক্সটাইল মিলসের সামনে থেকে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করা হয়।

ফরহাদ মজহার হানিফ পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৯৮০১ বাসে ঢাকায় ফিরছিলেন বলে জানিয়েছেন অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিসুর রহমান।

রাত ১টা ২০ মিনিটে খুলনার ফুলতলা থানায় র‍্যাব ও পুলিশ যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহমেদ, র‍্যাব-৬-এর পরিচালক খন্দকার রফিকুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে দিদার আহমেদ বলেন, ফরহাদ মজহারের ব্যাগে মোবাইল ফোনের চার্জার, শার্টসহ বেড়াতে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া গেছে। তিনি সুস্থ আছেন। তাঁকে অপহরণ করা হয়েছিল, নাকি নিজেই বের হয়েছিলেন—সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, অপহরণ নাটক সাজানো হয়েছিল বলে মনে হয়।

র‍্যাব-৬-এর পরিচালক খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে র‍্যাব জানতে পারে ফরহাদ মজহার দুপুর থেকে খুলনায় আছেন। সন্ধ্যায় অভিযান শুরু হয়। রাত ১০টার দিকে র‍্যাব জানতে পারে নিউমার্কেটের পাশে গ্রিল হাউস রেস্তোরাঁয়া তিনি রাতের খাবার খেয়েছেন।

হোটেলটির তত্ত্বাবধায়ক আবদুল মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, রাত সাড়ে আটটার দিকে ফরহাদ মজহার এসে সাদা ভাত, ডাল ও সবজি খেয়ে চলে যান। এরপর টেলিভিশনের খবরের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন ফরহাদ মজহার নিখোঁজ। পরে বিষয়টি তিনি র‍্যাবকে জানান।

আবদুল মান্নান বলেন, ফরহাদ মজহার একাই এসেছিলেন। তাঁর পরনে সাদা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি ও মাথায় সাদা রুমাল বাঁধা ছিল। তাঁকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।

রাতে উদ্ধারের পর ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে আশ্বস্ত হয়েছি। কিন্তু উদ্বেগহীন হতে পারছি না। তিনি বাসায় না ফেরা পর্যন্ত উদ্বেগ থাকবে।’

উদ্ধারের পর এক র‍্যাব কর্মকর্তার মাধ্যমে ফরহাদ মজহারের সঙ্গে কথা হয়েছে উল্লেখ করে ফরিদা আখতার বলেন, তিনি কীভাবে, কার সঙ্গে যশোর গেলেন, এ ব্যাপারে কথা হয়নি।

এর আগে রাত ১০টার দিকে শ্যামলীর হক গার্ডেনে ফরহাদ মজহারের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁর পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা। সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে নিরাপদ ও অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়ার দাবি জানানো হয়।

সকালে ওই বাড়ির গ্যারেজে দাঁড়িয়ে তাঁর বন্ধুরা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ভোর ৫টা ৫ মিনিটে ফরহাদ মজহার খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামেন। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফরহাদ মজহার স্ত্রী ফরিদা আখতারকে ফোন করে বলেন, ‘ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’

ফরহাদ মজহারের বন্ধু গৌতম দাশ বলেন, ‘ধারণা করছি, গেটের বাইরে যাওয়ামাত্রই কেউ তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে।’

ফরহাদ মজহার সাধারণত রাত তিনটার দিকে উঠে লেখালেখি করতেন বলে জানান তাঁর বন্ধুরা। তাঁরা বলেন, তিনি ঢাকায় থাকলে সাধারণত ভোরবেলায় হাঁটতে বের হন না। গতকাল ভোরে ফরহাদ মজহার কেন বেরিয়েছিলেন, সেটাই একটা রহস্য।

এর আগে সকাল ১০টার দিকে এক ব্যক্তি আদাবর থানায় গিয়ে ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হয়েছেন বলে মৌখিক অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে আদাবর থানার উপপরিদর্শক আলেয়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারসহ পুলিশের অন্য সদস্যরা হক গার্ডেনে ফরহাদ মজহারের বাসায় যান। অভিযোগ নিয়ে যে ব্যক্তি থানায় এসেছিলেন, তিনি জানিয়েছেন, ফরহাদ মজহার ফোনে তাঁর স্ত্রীকে ৩৫ লাখ টাকা জোগাড় করতে বলেছেন।

তবে মুক্তিপণের ব্যাপারে তাঁর বন্ধু-স্বজনেরা কেউ কিছু জানেন না বলে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন।

এ বিষয়ে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার বলেন, ‘আমরা ফরহাদ মজহারের ফোন ট্র্যাক (অবস্থান শনাক্ত) করে জানতে পেরেছি, কখনো তাঁর অবস্থান আরিচা, ফরিদপুর বা কখনো মাগুরায়। ওনার লোকেশন পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা তাঁকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

বিএনপির দাবি

ফরহাদ মজহার ‘অপহরণের’ পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি। দলের পক্ষে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এমনও হতে পারে, গতকাল (রোববার) দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সংবাদ সম্মেলনে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার জন্য তাঁকে টার্গেট করেছে সরকার। তিনি বলেন, ‘আমরা এ ধরনের ঘটনা আগেও দেখেছি। ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ অনেককেই এভাবে তুলে নেওয়া হয়েছে।’

বিএফইউজে ও ডিইউজের একাংশের উদ্বেগ

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ ও মহাসচিব এম আবদুল্লাহ এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের সভাপতি কবি আবদুল হাই শিকদার ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, ফরহাদ মজহার গুম, খুন, অপহরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। বিস্ময়করভাবে তাঁকেই অপহরণের শিকার হতে হয়েছে।

অ্যামনেস্টির উদ্বেগ

ফরহাদ মজহারকে ‘অপহরণের’ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। গতকাল সংস্থাটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অভিযোগ করা হয়, ‘বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকে নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁদের ভাগ্য সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। সরকারকে এ ধরনের ঘটনার দায়মুক্তির বিষয় অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে।’