বসতবাড়ির ঠিক সামনেই পঞ্চাশোর্ধ্ব মখলিছুর রহমানের এক একর ইরি ধানের জমি। সেখানে এখন কোমরসমান পানি। ঈদের আগের রাতে বিয়ানীবাজারের কুশিয়ারা নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ভেঙে হু হু করে পানি ঢুকে অন্য কৃষকদের মতো তাঁর জমিও প্লাবিত হয়েছিল। ঘরেও হাঁটুপানি ওঠে। এ অবস্থায় স্ত্রী ও ছয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে তিনি নিজ গ্রাম কাকরদিয়ার বাড়ি ছেড়ে পাশের ঘুঙ্গাদিয়া নোয়াগাঁওয়ে আশ্রয় নেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মখলিছুর পানিতে তলিয়ে যাওয়া তাঁর জমি ও বাড়িটি একনজর দেখতে আসেন। তাঁর নিজের হাতে রোপণ করা ধানের চারা এখন পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। হাত দিয়ে তিনি কিছু চারা ধরতেই গোড়াসহ উপড়ে আসে। মখলিছুর তা দেখাচ্ছিলেন আর কাঁদছিলেন। ঠিক এমন সময় কয়েকটি জোঁকও তাঁর পায়ে কামড়ে ধরে। জোঁকগুলো টেনে ছুড়ে ফেলতে ফেলতে মখলিছুর বিলাপ করেন, ‘জোঁকের কামড় না হয় সহ্য করলাম, কিন্তু বন্যার কামড় সহ্য করব কেমনে?’
গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিয়ানীবাজার উপজেলার কাকরদিয়া, মেওয়া, আঙ্গারজুর ও তেরদল এলাকা ঘুরে মখলিছুর রহমানের মতো আরও অন্তত ১৭টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের অভিন্ন ভাষ্য, বন্যার পানিতে তাঁদের ফসলি জমি থেকে শুরু করে বসতভিটা প্লাবিত হওয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুর্গত এলাকায় চর্মরোগ ও জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। এখনো গ্রামগুলোর অধিকাংশ নলকূপ পানিতে তলিয়ে থাকায় বিশুদ্ধ খাবার পানিরও তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রামগুলোর আশপাশে ফসলি জমি ও ঝোপঝাড় থাকায় সাপ ও জোঁকের উপদ্রবও বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত।
আঙ্গুরাজুরা গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মালিক (৬২) বলেন, ‘পানি কমতাছে ঠিকই। এবো (এখনও) কিছু কিছু কিছু জাগাত (জায়গায়) পানি রইছে। থুরা থুরা (অল্প) পানি নামের।’ তিনি জানান, তাঁদের গ্রামে শতাধিক বাড়িতে বন্যার পানি উঠেছিল। গত বুধবার রাত থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। বাড়িঘর থেকে পানি নেমে গেলেও অধিকাংশ বাড়ির আঙিনায় এখনো পানি রয়ে গেছে। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নানা ধরনের দুর্ভোগও বাড়ছে। এলাকায় চর্মরোগ, জ্বর ও ডায়রিয়ার প্রকোপও বাড়ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম আলী খান প্রথম আলো কে বলেন, বিয়ানীবাজারে এখনো এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে বন্যাকবলিত প্রতিটি ইউনিয়নে মেডিকেল টিম প্রস্তুত রয়েছে। তারা বন্যার্তদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা দেবে।
সিলেট-বিয়ানীবাজার আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে এখনো বন্যার পানি না সরায় যানবাহন চলছে ঝুঁকি নিয়ে। সড়কের চেংরি ব্রিজের সামনের অংশে হাঁটুসমান পানি। চেংরি ব্রিজ এলাকায় বন্যার পানি মাড়িয়ে বেলা পৌনে একটার দিকে কাকরদিয়া তেরদল উচ্চবিদ্যালয়ে যাচ্ছিল সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আলী হাসনাত ও ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আবিদ হোসেন। আঙ্গুরাজুরা গ্রামের এই দুই ছাত্র জানায়, তাদের পরীক্ষা চলছে। তাই পানি উপেক্ষা করেই রওনা হয়েছে। নাহলে যেভাবে জোঁকের উপদ্রব বেড়েছে, তারা বন্যার পানি না কমা পর্যন্ত বিদ্যালয়েই যেত না। জোঁক ঠেকাতে পায়ে তেল মালিশ করে এসেছে বলে জানাল তারা।
বন্যাদুর্গত এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, এলাকায় খাবারের সংকট খুব একটা নেই। তবে বন্যায় অধিকাংশ নলকূপ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কাকরদিয়া গ্রামের ট্রাকচালক এরশাদ মিয়া (৩৫) বলেন, ‘টিউবওয়েল ডুইবা যাওয়ায় খাইবার পানির সংকটটাই বেশি দেখা দিছে। তাই দূর-দূরান্তের একটু উঁচা জায়গায় যেখানে পানি উঠছে না, সেখান থাকি ঘরের মহিলারা হাঁইটা পানি নিয়া আসে।’
বন্যা পরিস্থিতির ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মু. আসাদুজ্জামান প্রথম আলো কে বলেন, উপজেলার পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঁচটি এবং চারটি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এসব দল গত বুধবার থেকে বন্যার্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করেছে। এ ছাড়া বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট মেটাতে বন্যার্তদের মধ্যে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট প্রচুর পরিমাণে বিতরণ করা হচ্ছে।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে