জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সিলেট, চট্টগ্রাম কেন পিছিয়ে?

সারা দেশে মোট প্রজনন হার বা নারীপ্রতি সন্তান জন্ম (টিএফআর) যেখানে ২ দশমিক ৩ জন, সেখানে সিলেটে তা ২ দশমিক ৯ জন। আর চট্টগ্রামে তা ২ দশমিক ৫। প্রতীকী ছবি
সারা দেশে মোট প্রজনন হার বা নারীপ্রতি সন্তান জন্ম (টিএফআর) যেখানে ২ দশমিক ৩ জন, সেখানে সিলেটে তা ২ দশমিক ৯ জন। আর চট্টগ্রামে তা ২ দশমিক ৫। প্রতীকী ছবি

পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়নে সাফল্য দেখাতে পারছে না সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগ। সারা দেশে মোট প্রজনন হার বা নারীপ্রতি সন্তান জন্ম (টিএফআর) যেখানে ২ দশমিক ৩ জন, সেখানে সিলেটে তা ২ দশমিক ৯ জন। আর চট্টগ্রামে তা ২ দশমিক ৫। এ ক্ষেত্রে সাফল্য আছে রংপুর ও খুলনা বিভাগের। রংপুর ও খুলনায় তা ১ দশমিক ৯ জন।
জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারেও এই দুটি বিভাগে দম্পতিরা পিছিয়ে। বর্তমানে দেশে গড়ে ৬২ দশমিক ৪ ভাগ দম্পতি পদ্ধতি ব্যবহার করেন। কিন্তু সিলেটে তা ৪৮ এবং চট্টগ্রামে ৫৫।
জন্মনিয়ন্ত্রণের বার্তা পৌঁছেনি বা সচেতনতার কর্মসূচির বাইরে আছেন, এমন দম্পতির হার ১২ শতাংশ। চট্টগ্রামে তা ১৭ এবং সিলেটে ১৮।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত ‘পরিবার পরিকল্পনা ও মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি’ পুস্তিকায় এ তথ্য মিলেছে। এতে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত তথ্য হালনাগাদ করা হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখানে প্রকাশিত তথ্যই সর্বশেষ তথ্য।
১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এবারে দিবসের স্লোগান-‘পরিবার পরিকল্পনা, জনগণের ক্ষমতায়ন, জাতির উন্নয়ন।’
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সিলেটে ও চট্টগ্রাম বিভাগের পিছিয়ে থাকার কারণ কী? জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের যেকোনো কর্মসূচি সিলেট ও চট্টগ্রামে বাস্তবায়নে বেগ পেতে হয়। এখানকার ভৌগোলিক অবস্থান, প্রবাসী আয়সহ অর্থনৈতিক অবস্থা এ ক্ষেত্রে প্রভাব রাখে। তবে আমরা ওই এলাকায় যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলো কাটানোর চেষ্টা করছি এবং নতুন নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি।’ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর নতুন যে জরিপ শুরু করেছে, তাতে এই বিভাগে ভালো ফল আসবে বলে আশাবাদী কাজী মোস্তফা সারোয়ার।
সিলেট ও চট্টগ্রামে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমের বিষয়টিকে ভিন্নভাবে বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আমিনুল হক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মানুষের স্থানীয় বৈশিষ্ট্য ও চিন্তাচেতনা বুঝতে হবে আগে। দেশের অন্য এলাকার নীতি এই দুটি বিভাগে কাজে লাগবে না। সিলেট ও চট্টগ্রামের মানুষের বোধকে বুঝে নীতি ঠিক করতে হবে।
অধ্যাপক আমিনুল হক বলেন, ‘আমাদের পরিবার পরিকল্পনার যে কর্মসূচি এখন চলছে, তা অন্তত চার দশক আগের। এখন মানুষের আয়, শিক্ষা বেড়েছে। এখন এই কর্মসূচির ধরনধারণ পরিবর্তন করতে হবে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, এমএ পাস সেবাগ্রহীতাকে এসএসসি পাস মাঠকর্মী কীভাবে সচেতন করবেন? তাঁর মতে, এখন সময় এসেছে টার্গেট গ্রুপ ঠিক করা কাজে নামা।
তা ছাড়া গণমাধ্যম ব্যবহারেও নীতি পাল্টাতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক আমিনুল হক। টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্রের পাশাপাশি সামাজিক গণমাধ্যমকেও কাজে লাগাতে হবে।
দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বর্তমানে ১ দশমিক ৩৭ ভাগ। মোট প্রজনন হার অর্থাৎ নারীপ্রতি সন্তান জন্ম হচ্ছে ২ দশমিক ৩ জন। এ দুটি হার সাত বছর ধরেই এক জায়গায় স্থির হয়ে রয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রজনন হার কমানো না গেলেও বৃদ্ধি ঠেকানোকেই একধরনের সফলতা বলে আখ্যায়িত করছেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
কিন্তু অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনো দেশের ৩৭ ভাগের বেশি দম্পতি পরিবার পরিকল্পনার কোনো পদ্ধতিই ব্যবহার করছে না।
এ বিষয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পদক্ষেপ জানতে চাইলে কাজী মোস্তফা সারোয়ার বলেন, ‘আমাদের জনবল-সংকট আছে। তবে আমরা লক্ষ্য নির্ধারণ করে সচেতনতা তৈরির কাজ করে যাচ্ছি।’

ম্যাপ
ম্যাপ

বিভাগওয়ারি চিত্র: (‘পরিবার পরিকল্পনা ও মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচি’ শীর্ষক পুস্তিকা)
রংপুর: পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে রংপুর বিভাগের সাফল্য বেশি। এখানে মোট প্রজনন হার বা নারীপ্রতি সন্তান জন্ম (টিএফআর) ১ দশমিক ৯ জন। এ বিভাগে প্রতি ১০০ দম্পতির মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন ৭০ জন দম্পতি। তবে জন্মনিয়ন্ত্রণের বার্তা পৌঁছেনি বা সচেতনতার কর্মসূচির বাইরে আছেন এমন দম্পতি ৭ শতাংশ।
খুলনা: জন্মনিয়ন্ত্রণে সাফল্য আছে খুলনা বিভাগের। এ বিভাগের দম্পতিদের মধ্যে ৬৭ ভাগই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন। খুলনায় নারীপ্রতি গড় জন্ম রংপুরের মতোই অর্থাৎ ১ দশমিক ৯ জন। সচেতনতার কর্মসূচির বাইরে আছেন এমন দম্পতি ৯ শতাংশ।
রাজশাহী: রংপুর, খুলনার মতো না হলেও কাছাকাছি অবস্থানে আছে রাজশাহী বিভাগ। এখানে নারীপ্রতি গড় সন্তান জন্ম ২ দশমিক ১ জন। এ বিভাগে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন এমন দম্পতির সঙ্গে প্রতি ১০০ জনে ৬৯ জন। এ বিভাগে ৮ ভাগ দম্পতির কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বার্তা পৌঁছেনি।
ঢাকা: পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে ঢাকা বিভাগের বিশেষ সাফল্য নেই। এখানে ১২ শতাংশ দম্পতির কাছেই জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বার্তা পৌঁছেনি। এদিক থেকে রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগ থেকে পিছিয়ে ঢাকা। এখানে নারীপ্রতি গড় জন্ম ২ দশমিক ৩ জন। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন ৬৩ ভাগ দম্পতি।
বরিশাল: বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু এলাকা দুর্গম চরাঞ্চল। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মীরা কখনো কখনো এসব এলাকায় পৌঁছাতে পারেন না। এ বিভাগে ১১ ভাগ দম্পতির সচেতনতা কর্মসূচির বাইরে আছেন। বরিশাল বিভাগে নারীপ্রতি গড় জন্ম ২ দশমিক ২ জন। এখানে দম্পতিদের ৬৩ ভাগ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন।
চট্টগ্রাম: জন্মনিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দুই বিভাগের একটি চট্টগ্রাম। এখানে নারীরা গড়ে ২ দশমিক ৫টি সন্তান জন্ম দেন। পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতি গ্রহণ করেন ৫৫ শতাংশ দম্পতি। এখানে ১৭ শতাংশ দম্পতির কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণের বার্তাই পৌঁছেনি।
সিলেট: পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির দুঃখ সিলেট বিভাগ। ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্মীয় রক্ষণশীলতা এখানে সরকারের কর্মসূচিকে সফল হতে দিচ্ছে না। এখানে নারীপ্রতি সন্তান জন্ম প্রায় তিনজন বা ২ দশমিক ৯ জন। এ বিভাগে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন না বেশির ভাগ দম্পতি। অর্থাৎ ৪৮ ভাগ দম্পতি পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ১৮ ভাগ দম্পতির কাছে পরিবার পরিকল্পনার বার্তা পৌঁছানো হয়নি।

চট্টগ্রাম ও সিলেটের কর্মকর্তারা যা বলছেন
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের উপপরিচালক উ খ্যে উ ইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার চিত্র খারাপ নয়। তবে, এ বিভাগে পার্বত্য এলাকা ও উপকূলীয় এলাকা আছে। সেখানে আমাদের মাঠকর্মীরা সব সময় পৌঁছাতে পারেন না।’ তিনি বলেন, এই মুহূর্তে জেলায় পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকার ২৫৩ পদের মধ্যে ৬৮টি শূন্য রয়েছে। এই পরিদর্শিকারাই ইউনিয়ন পর্যায়ে কাজ করেন। এ ছাড়া জেলায় পরিবারকল্যাণ সহকারী, যাঁরা মাঠকর্মী নামে পরিচিত, তাঁদের ১ হাজার ৩৫টি পদের মধ্যে ২৭৭টি পদ শূন্য রয়েছে।
সিলেটের একাধিক অঞ্চলে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে মাঠপর্যায়ে কাজ করেছেন, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন এক কর্মকর্তা শনিবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সিলেটে ধর্মীয় গোঁড়ামি এখনো কিছু মানুষের মধ্যে প্রভাব ফেলছে, যদিও তা কমে এসেছে। এ ছাড়া কানাইঘাট, গোয়াইনঘাটের মতো প্রত্যন্ত এলাকা আছে, আছে হাওর এলাকা, যেখানে পরিবার পরিকল্পনার বার্তা পৌঁছানো কঠিন। তা ছাড়া এই এলাকার একটি অংশ প্রবাসী, যাঁরা দেশে এসে দুই তিন মাস থেকে আবার চলে যান। তাঁরা পরিবার পরিকল্পনার বিষয়টি আমলে নেন না। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনে কাজে সমন্বয় না থাকাও একটা সমস্যা।
এই কর্মকর্তা বলেন, সমস্যার প্রত্যেকটি বিষয় ধরে ধরে কাজ করলে সিলেট বিভাগেও সাফল্য আসবে।