নগরে স্বর্ণলতা...

পুরো গাছ ছেয়ে আছে স্বর্ণলতায়। শিকড় নেই, পাতা নেই, তবুও মাথা উঁচু করে যেন আকাশ ছুঁতে চায় এই স্বর্ণলতা। ছবিটি রাজধানীর ফার্মগেট-সংলগ্ন পার্ক থেকে তোলা। ছবি: মুসলিমা জাহান
পুরো গাছ ছেয়ে আছে স্বর্ণলতায়। শিকড় নেই, পাতা নেই, তবুও মাথা উঁচু করে যেন আকাশ ছুঁতে চায় এই স্বর্ণলতা। ছবিটি রাজধানীর ফার্মগেট-সংলগ্ন পার্ক থেকে তোলা। ছবি: মুসলিমা জাহান

‘মা দেখো, ওই গাছটিতে কী সুন্দর ফুল ফুটেছে। হলুদ হলুদ ফুল।’ মেয়ের কথায় একটু দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকান মা। হেসে বলে ওঠেন, ‘এটা তো ফুল নয়, একধরনের লতা। নাম স্বর্ণলতা। অন্য গাছে থাকে।’


এভাবেই তৃতীয় শ্রেণিপড়ুয়া রিসাত হাসানের সঙ্গে স্বর্ণলতার পরিচয় করিয়ে দেন মা। রাজধানীর ফার্মগেটসংলগ্ন পার্কের একটি বরইগাছে ঠাঁই নিয়েছে পরজীবী স্বর্ণলতা। শিকড় নেই, পাতা নেই। তবু মাথা উঁচু করে যেন আকাশ ছুঁতে চায়। লতাই এর মূল দেহ বা কাণ্ড। উদ্ভিদটির দেহ সোনালি রঙের; চিকন লতার মতো, তাই এমন নামকরণ। তবে কোথাও কোথাও এটি আলোকলতা বা শূন্যলতা নামেও পরিচিত।

স্বর্ণলতা এই নগরের মানুষের কাছে তেমন পরিচিত নয়। এমনকি কংক্রিটের এই শহরে খুব একটা দেখাও যায় না। সুমন রহমান, রাব্বি শিকদার, মামুন হোসেন—কলেজপড়ুয়া তিন বন্ধু মিলে পার্কে আড্ডা দিচ্ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুজনের কাছেই লতাটি অচেনা। একজন দেখলেও নাম জানেন না।

গাছটির নিচে বসেই আমড়া কাটছিলেন বিক্রেতা রহমতউল্লাহ। তিনি হেঁটে হেঁটে আমড়া বিক্রি করেন। তিনিও এই লতাটির নাম জানেন না। তবে গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে দেখেছেন। সবচেয়ে অবাক হয়েছেন পার্শ্ববর্তী তেজগাঁও কলেজের চার ছাত্র। বলেন, তাঁরা প্রতিদিন অনেকটা সময় এই পার্কে কাটান, অথচ কখনো লতাটি নজরেই আসেনি। তবে লতাটি সম্পর্কে একবাক্যে সবার সরল স্বীকারোক্তি, ‘সুন্দর। লতাটি বেশ সুন্দর।’

স্বর্ণলতা। ছবি: মুসলিমা জাহান
স্বর্ণলতা। ছবি: মুসলিমা জাহান

রাস্তার পাশের কোনো কাঁটাযুক্ত গাছকে আশ্রয় করেই এর জন্ম বা বেড়ে ওঠা। বরই, বাবলাগাছে এদের মূল বসবাস বলে বইপুস্তক ঘেঁটে জানা যায়। লতাটি আশ্রয়দাতা গাছে নিজের মূল কাণ্ড গেঁথে চোষকের মাধ্যমে খাবার খাওয়ার কাজটি সেরে নেয়। তবে একসময় আর মূল কাণ্ড খুঁজে পাওয়া যায় না। লতাটি দ্রুত বেড়ে ওঠে। অনেক সময় আশ্রয়দাতা গাছটির মৃত্যুর কারণ হয় দৃষ্টিনন্দিত এই লতা। তাই পরিকল্পিত বাগান বা উদ্যানে তেমন একটা দেখা যায় না। বাগানের মালিকদেরও অপছন্দের তালিকায় পরজীবী এই উদ্ভিদ।

শীতকাল লতাটিতে ফোটে ছোট ছোট ঘণ্টাকার ফুল। সেই দুধসাদা রঙের ফুলের ঘ্রাণে ছোটে পিঁপড়া ও মৌমাছি। ফুল আকৃতিতে অনেক ছোট হয়। গ্রামের শিশুদের কাছে লতাটি বেশ আকর্ষণীয়। এই লতা পেঁচিয়ে ব্যান্ডানা বানিয়ে মাথায় পরে ঘুরে বেড়ায় শিশুরা। এক বর্ষজীবী এই লতার ঔষধি গুণও অনেক। এর রস ক্ষত ও নানা ধরনের ব্যথা উপশমে বেশ কার্যকর। বলকারকও বটে। এ ছাড়া লতার রস প্রজনন রোধে এবং গর্ভপাতেও ব্যবহৃত হয়।

লতাটির বৈজ্ঞানিক নাম Cuscuta Reflexa। ভারতীয় উপমহাদেশেই এর আধিক্য। ভারতে এটি ‘অমর বেল’ এবং নেপালে ‘আকাশ বেলি’ নামে পরিচিত। সারা বিশ্বে Cuscuta এই গণের দেড় শতাধিক প্রজাতির স্বর্ণলতা রয়েছে। বাংলাদেশে চার প্রজাতির পাওয়া যায় উল্লেখ আছে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘গাছপালা তরুলতা’ নামক গ্রন্থে। শিল্প-সাহিত্যেও এই লতার ব্যবহার আছে। জীবনানন্দ দাশও তাঁর কবিতার ছন্দ বুনতে ব্যবহার করেছেন চমৎকার এই উদ্ভিদের নাম।