বাবু ডাইং বরেন্দ্রর ভূস্বর্গ

যত দূর চোখ যায়, শুধু গাছ আর গাছ। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বাবু ডাইংয়ের দৃশ্য। গত সোমবার তোলা ছবি l শহীদুল ইসলাম
যত দূর চোখ যায়, শুধু গাছ আর গাছ। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বাবু ডাইংয়ের দৃশ্য। গত সোমবার তোলা ছবি l শহীদুল ইসলাম

দূর থেকে তাকালে মনে হয় ঢেউখেলানো বনভূমি। গাছের পরে গাছ। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে শান্ত জলের আঁকাবাঁকা খাড়ি। কাছে এলে মন হারিয়ে যায় টিলার চূড়ায়। ঘন সবুজ ঘাসে ঢাকা অদ্ভুত সুন্দর উঁচু-নিচু এই ভূমির তুলনা নেই। পাখি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বনেই বাসা বেঁধে বাচ্চা ফুটিয়েছে তিন জাতের বিরল প্রজাতির পাখি। দেশের আর কোথাও এদের প্রজনন করতে দেখা যায় না। রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে এই অপূর্ব বনভূমি, নাম ‘বাবু ডাইং’। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এই বনভূমি। মোট আয়তন ৯৬৬ দশমিক ৪৫ একর। তবে বনভূমির ভেতরের সমতল অংশে স্থানীয় লোকজন চাষাবাদ করেন। এগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন হয়ে গেছে।

১৭ জুলাই বাবু ডাইং বনভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, পাকা রাস্তা একেবারে বন পর্যন্ত চলে গেছে। শেষ মাথায় একটা গোলচত্বর করা হয়েছে। চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ। কোথাও জনমানবের সাড়া নেই। গাছে গাছে পাখিরা যা বলছে, তা-ই কানে ভেসে আসছে। সঙ্গে ছিলেন পাখিপ্রেমিক তারেক অনু। তিনি অচেনা অনেক পাখির নাম-পরিচয় বলে যাচ্ছিলেন। গোলচত্বরটি মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক উঁচুতে। সেখান থেকে পুব দিকের টিলার মতো উঁচু-নিচু ভূমিটিই বাবু ডাইং নামে পরিচিত। ওই চত্বর থেকে তাকালে মনে হয়, ঢেউখেলানো অদ্ভুত এক বন। মাঝখানে একটা বড় খাড়ি। বাবু ডাইংয়ে যাওয়ার
জন্য খাড়ির ওপরে একটি কালভার্ট তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কালভার্ট পার হয়ে দুপাশের ঘাসের মাঝ দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ। মনে হলো পথটাই পায়ে-পায়ে টেনে নিয়ে গেল বনের মাঝখানে। সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো অপূর্ব এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের মাঝখানে পথহারানো এক জায়গা। খাড়ির ওপরে দক্ষিণ পাশে উঁচু গাছের মগডাল পর্যন্ত বেয়ে উঠেছে লতাগাছ। নির্জন বনে দেখা গেল টিলার ওপর থেকে ঘাসবনের ভেতর দিয়ে একজন মানুষ নেমে আসছেন। তাঁর নাম রেণু কোল। বনের ভেতরের জমি চাষ করেন। তাঁরা যেন এই বনভূমিরই সন্তান। প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে রয়েছেন। সঙ্গী পাখিপ্রেমিক বললেন, বনভূমির এই ঘাসের ভেতরেই পাখিদের অন্যতম খাদ্য ‘পোকা’ পাওয়া যায়। এই খাদ্যনিরাপত্তার জন্যই পাখিরা এই বন ছাড়ে না। তিনি গত শীতের মধ্যে এসে দেখেছিলেন স্থানীয় লোকজন এই ঘাস পুড়িয়ে দিয়েছেন। এটা পাখিদের জন্য হুমকিস্বরূপ।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক ১৮ বছর ধরে বাবু ডাইংয়ে আসা-যাওয়া করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সরকারিভাবে ৪০টি জাতীয় উদ্যান সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু বরেন্দ্র ভূমির একটি জায়গাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করতে হলে বাবু ডাইংকেই করতে হবে। এমন অসাধারণ ভূ-সৌন্দর্য বরেন্দ্র অঞ্চলে আর দ্বিতীয়টি নেই। এটি সরকারের হাতেই রয়েছে। শুধু সংরক্ষিত ঘোষণা করতে হবে। তাহলে বরেন্দ্র ভূমিও জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি পাবে। তিনি ২০ বছর ধরে তামাপিঠ লাটোরা দেখার জন্য খোঁজ করছিলেন। গত বছর প্রথম তাদের ঢাকায় দেখা গেছে। সে বছরই বাবু ডাইংয়ে গিয়ে দেখা গেল বাচ্চাসহ এক জোড়া তামাপিঠ লাটোরা। বললেন, এখানে অন্তত তিনটি বিরল প্রজাতির পাখি রয়েছে (তামাপিঠ লাটোরা, মেঠো-রাতচরা,দেশি-রাতচরা)। তাই এলাকাটিকে সংরক্ষিত করা উচিত। তাহলে এটা বিনোদনকেন্দ্র হতে পারে, নিয়ন্ত্রিত পিকনিক কর্নার হতে পারে। হতে পারে পাখির অভয়ারণ্য।

ফেরার পথে কথা হলো গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ নেওয়াজের সঙ্গে। তিনি বললেন, সরকার থেকে গোদাগাড়ী উপজেলার সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্রের তালিকা চাওয়া হয়েছে। তাঁরা পর্যটনকেন্দ্রের জন্য বাবু ডাইংয়ের নাম প্রস্তাব করবেন।