ঊর্মি-বাসন্তীর পর এবার সাগরকন্যা

পিঠে স্যাটেলাইট যন্ত্র নিয়ে সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে ‘সাগরকন্যা’  প্রথম আলো
পিঠে স্যাটেলাইট যন্ত্র নিয়ে সমুদ্রে নেমে যাচ্ছে ‘সাগরকন্যা’ প্রথম আলো

ঊর্মি বাসন্তীর পর এবার পিঠে স্যাটেলাইট যন্ত্র নিয়ে গভীর সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে ‘সাগরকন্যা’ নামে আরেকটি অলিভ রিডলে প্রজাতির মা কচ্ছপ। সামুদ্রিক কচ্ছপের গতিবিধি, বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন এবং সমুদ্রের অজানা তথ্য অনুসন্ধানের জন্য বেসরকারি গবেষণা সংস্থা মেরিন লাইফ অ্যালায়েন্স আধুনিক প্রযুক্তির এই স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং শুরু করে।
ছুটে চলেছে সাগরকন্যা: গত ১১ জানুয়ারি ভোররাতে অলিভ রিডলে প্রজাতির একটি মা কচ্ছপ গভীর সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে আসে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের ডায়াবেটিকস হাসপাতাল পয়েন্টে। বালুচরে গর্ত করে ডিম পাড়ে ১০৯টি। এরপর সমুদ্রে নেমে যাওয়ার সময় মেরিন লাইফ অ্যালায়েন্স কর্মীরা কচ্ছপটি ধরে ফেলেন। এরপর গর্তের ডিম ও মা কচ্ছপটিকে তাঁরা সংরক্ষণ করেন। কচ্ছপটির দৈর্ঘ্য ৬৩ সেন্টিমিটার। ওজন ৩০ কেজি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কচ্ছপটি সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে। এ কারণে ওজন কম এবং আকারেও ছোট।
পরের দিন ১২ জানুয়ারি বিকেলে কচ্ছপটির পিঠে স্থাপন করা হয় একটি স্যাটেলাইট যন্ত্র (ট্রান্সমিটার)। এরপর সৈকতের সমিতিপাড়া পয়েন্ট দিয়ে কচ্ছপটি সমুদ্রে অবমুক্ত করা হয়। কচ্ছপটির নাম রাখা হয় সাগরকন্যা।
গত ছয় দিনে (১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত) কচ্ছপটি মহেশখালী-সোনাদিয়া চ্যানেল অতিক্রম করে পশ্চিম দিকে চলে যাচ্ছে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের লাবণী পয়েন্ট থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৪৭ কিলোমিটার।
মেরিন লাইফ অ্যালায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক জহিরুল ইসলাম জানান, চলতি বছর সাগরকন্যার মতো আরও ২০টি কচ্ছপের পিঠে স্যাটেলাইট যন্ত্র স্থাপন করে সাগরে অবমুক্ত করা হবে।
নজরে গতিবিধি: মেরিন লাইফ অ্যালায়েন্স সূত্র জানায়, স্যাটেলাইট যন্ত্রটি সচল করার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের নোয়া ও নাসা এবং ফ্রান্সভিত্তিক পরিবেশ-উপাত্ত সংগ্রহকারী স্যাটেলাইট রিসিভার আরগোসে সংকেত পাঠানো শুরু করে। সাগরকন্যা সমুদ্রের পানিতে ভেসে ওঠামাত্রই ট্রান্সমিটারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এর অবস্থান সম্পর্কিত সংকেত পাঠাবে। প্রতিটি স্যাটেলাইট ভূপৃষ্ঠের পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা প্রতি মুহূর্তে স্ক্যান করে থাকে। তাই সাগরকন্যা পৃথিবীর যে প্রান্তেই ভ্রমণ করবে, তা ধরা পড়বে স্যাটেলাইটে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সাগরকন্যার গতিপথ জানা যাবে www.seaturtle.org/tracking/?project_id=487 এই ঠিকানায়।
এখনো নিখোঁজ ঊর্মি ও বাসন্তী: ২০১০ সালের ২৯ মার্চ মহেশখালীর সোনাদিয়া সৈকতে ডিম পাড়তে এসেছিল অলিভ রিডলে প্রজাতির একটি মা কচ্ছপ। এই কচ্ছপের পিঠে প্রথম স্যাটেলাইট যন্ত্র স্থাপন করে মেরিন লাইফ অ্যালায়েন্স কর্তৃপক্ষ সাগরে অবমুক্ত করে। কচ্ছপটির নাম রাখা হয় ‘ঊর্মি’। ২০১১ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত প্রায় এক বছর সময়ে ঊর্মি কক্সবাজার থেকে ভারত সাগর হয়ে এক হাজার ২৫০ কিলোমিটার দূরে শ্রীলঙ্কায় চলে যায়। এরপর সেখান থেকে আবার বাংলাদেশের দিকে আসতে শুরু করে। কক্সবাজার সৈকত থেকে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দূরে এসে যন্ত্রটি অচল হয়ে পড়ে। এরপর ঊর্মির আর সন্ধান পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয় দফায় ২০১৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আরেকটি কচ্ছপের পিঠে স্যাটেলাইট যন্ত্র স্থাপন করে সমুদ্রে অবমুক্ত করা হয়। কচ্ছপটির নাম রাখা হয় ‘বাসন্তী’। এটি কক্সবাজার থেকে ভারত হয়ে ৮২ দিনের মাথায় মাদ্রাজ সাগরে পৌঁছে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’-এর কবলে পড়ে। এরপর থেকে বাসন্তীরও খবর নেই।
কচ্ছপ বিশেষজ্ঞ জহিরুল ইসলাম বলেন, সামুদ্রিক কাছিম পরিযায়ী প্রাণী। প্রজনন ও ডিম পাড়ার মৌসুমে এরা এক অঞ্চলে এবং বাকি সময় অন্য অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়, যা প্রজাতি ভেদে ১২ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এ জন্য এদের সাগর-মহাসাগরে এবং উপকূলে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ ও অন্যান্য কার্যক্রমের বলি হতে হয়। বিশেষ করে মা চিংড়ি ধরার ট্রলিং জাল, নিষিদ্ধ বেহন্দি জাল, ভাসা জাল এবং বরশিতে আটকা পড়ে প্রতিবছর হাজার হাজার মা কচ্ছপের মৃত্যু হচ্ছে।
তিনি জানান, বাংলাদেশে সামুদ্রিক কাছিম সাগরের কোথায় কোথায় পরিভ্রমণ করে এবং কোন পথে পরিযায়ী হয় সেটা জানা জরুরি। এই গবেষণার মাধ্যমে কচ্ছপের নিরাপদ ভ্রমণ এলাকা চিহ্নিতকরণ এবং সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।