আনারসের রাজধানীতে এক চক্কর

টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুরের ‘২৫ মাইল’ নামের জায়গায় এ সময়টায় গেলে আপনাকে থামতেই হবে। তা আপনি যে যানবাহনেই যান না কেন। রাস্তার দুই পাশজুড়ে জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এখানে বসে বিরাট বাজার, প্রায় প্রতিদিন। এ বাজার আনারসের। প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ বাজারের বিস্তৃতি। খুব স্বাভাবিক। কারণ, এই একটি উপজেলায় দেশের মোট আনারসের ৪০ শতাংশের বেশি উৎপাদিত হয়। প্রতিদিন অন্তত ২৫টি ট্রাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায় এই আনারস।

গত শনিবার দুপুর ১২টার দিকে ওই পথে যেতে আমাদেরও থামতে হলো। দুই পাশে ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, পিকআপ ও ট্রাকে চলছে আনারস ওঠানো-নামানো। রাস্তার দুই দিকে স্তূপ করে রাখা আছে আনারস। সবুজ লতাগুল্ম দিয়ে ঢাকা সেসব স্তূপ। একটি পিকআপে ওঠানো হচ্ছিল আনারস। সেখানে থাকা আমিনুল ইসলাম বললেন, ‘এ আনারস যাইতাছে সিলেট। দ্যাশের হগ্গল (সকল) জায়গায় যায় এডি (এটা)।’
২৫ মাইল মধুপুরের ঐতিহ্যবাহী শালবনের একেবারে লাগোয়া। এই বনভূমির একটি বড় অংশজুড়ে হয় আনারসের চাষাবাদ। এখন ভর মৌসুম এ ফলের। সকাল থেকেই এই ২৫ মাইল এলাকায় সাইকেল, ভ্যান বা ঘোড়ার গাড়িতে আনা হয় আনারস। তিন মাস ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের ভিড় জমে এই গ্রামীণ জনপদে। এঁদের একজন জয়পুরহাটের কালাম মিয়া। তিনি আজ প্রায় ছয় বছর আনারসের ব্যবসা করেন। বললেন, ‘তিন মাসে বার আষ্টেক আসা হয় এটি (এখানে)। অক্টোবর মাসের দিকে আবার ফসল উঠলে তখনো কয়েকবার আসি।’
সেদিন বাজারটা ছিল একটু চড়া। ছোট আকারের ব্যবসায়ীরা ১০০ আনারস কিনছেন দুই হাজার টাকায়। তিন ভ্যান আনারস ছয় হাজার টাকায় বিক্রি করলেন মোস্তফা। বিক্রি করা আনারস ভ্যানে তুলে নিজেই দড়ি দিয়ে তা বেঁধে দিচ্ছেন। বললেন, ‘আট পাখি (প্রতি পাখি ৩০ শতাংশ) জমিতে আবাদ করছিলাম। ফলন আল্লাহর রহম ভালো।’

মধুপুরের আনারসের বাজার । ছবি: পার্থ শঙ্কর সাহা
মধুপুরের আনারসের বাজার । ছবি: পার্থ শঙ্কর সাহা

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৫-১৬ সালে দেশে ২০ হাজার হেক্টর বেশি পরিমাণ জমিতে আনারস চাষ হয়। সে বছর মোট উৎপাদন হয়েছিল ৪ লাখ ৬০ হাজার ৬১১ মেট্রিক টন। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের ৭ হাজার ৯৮০ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৩ হাজার ৮২০ মেট্রিক টন আনারস উৎপাদিত হয়। আর শুধু মধুপুরেই হয় ১ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ দেশের ৪২ শতাংশ আনারস হয়েছে এই একটি উপজেলাতেই।
মধুপুরে দুই ধরনের আনারস হয়। একটি জায়েন্ট কিউ আর অন্যটি হানি কুইন। এর মধ্যে আকারে বড় জায়েন্ট কিউই বেশি আবাদ হয়।
টাঙ্গাইলের মধুপুরের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘এ বছর উপজেলার সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে আনারস চাষ হয়েছে। আনারস আবাদ কিছু কমছে। কারণ মানুষ কলা বা অন্যান্য ফলের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।’

পঁচিশ মাইল বাজারের আনারস। ছবি: পার্থ শঙ্কর সাহা
পঁচিশ মাইল বাজারের আনারস। ছবি: পার্থ শঙ্কর সাহা

আনারস থেকে কিছুটা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ হিসেবে স্থানীয় কৃষকেরা সংরক্ষণের অভাবকেই দায়ী করেন।
স্থানীয় কৃষক মোবারক বললেন, ‘বিঘাপ্রতি চার হাজার পিস আনারস হয়। এবারও তা-ই হইছে। তয় মাল রাখা যায় না। পইচ্যা যায়।’
এখন ময়মনসিংহের ভালুকাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান মধুপুর থেকে আনারস নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে। তবে তা খুব সীমিত আকারে হয় বলে জানায় কৃষি দপ্তর। তবে এ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য একটি সুখবর জানালেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান। বললেন, ‘হরটেক্স ফাউন্ডেশন একটি ফল সংরক্ষণাগার করার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এটি হলে এ অঞ্চলের কৃষকদের দুর্দশা কিছুটা কমবে।’