নাশকতা মামলার আসামিকে পদে বসাতে অনিয়ম!

তিনি বিএনপি-জামায়াতের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। নাশকতার মামলায় তিন মাস জেলও খেটেছেন। আদালতে দেওয়া পুলিশের অভিযোগপত্রে তাঁর নাম আছে। এরপরও বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ পেয়েছেন। অথচ উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা বিদ্যালয়টির সভাপতি। আবার ওই শিক্ষকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী অপর দুজনই ভুয়া বলে অভিযোগ উঠেছে।

ওই শিক্ষকের নাম মতিয়ার রহমান। তিনি লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বাউরা পাবলিক দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে তিনি এ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, মতিয়ার রহমান ১৯৯৭ সালে বাউরা পাবলিক দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। তিনি বিএনপির অনুসারী হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এরপরও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি পাটগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম এবং প্রধান শিক্ষক আজিজার রহমানের পছন্দে তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক হয়েছেন।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও থানা-পুলিশ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর বাউরা পাবলিক দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে জনসভার আয়োজন করে। এদিন সন্ধ্যায় ‘জামায়াত-বিএনপির’ নেতা-কর্মীরা ওই সভাস্থলে তাণ্ডব চালান। এ ঘটনায় পাটগ্রাম থানায় মামলা হয়। পুলিশ ২০১৫ সালে নাশকতার ওই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এতে শিক্ষক মতিয়ার রহমানের নামও রয়েছে। তিনি গ্রেপ্তার হয়ে তিন মাস কারাগারেও ছিলেন।

প্রধান শিক্ষক আজিজার রহমানের মুঠোফোন নম্বরে কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। পরিচালনা কমিটির সভাপতি আওয়ামী লীগের নেতা আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বিধি মেনেই মতিয়ার রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নাশকতার মামলার আসামিকে নিয়োগ দেওয়া ঠিক হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনো যেহেতু তিনি (মতিয়ার) আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হননি, তাই তাঁকে নাশকতাকারী হিসেবে ধরা যাবে না।

এদিকে ওই নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে আবেদন করা হয়েছে। নিয়োগের জন্য আবেদনকারী সাতজন (একমাত্র মতিয়ার বাদে) এ আবেদন করেছেন।

আবেদন সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য গত ১৯ মে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ জুলাই পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য আবেদনকারী আটজনকে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু অন্য সাতজন আগেই জেনে যান, এ পদে ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মতিয়ার রহমানকেই নিয়োগ দেওয়া হবে। এর প্রতিবাদে আবেদনকারী অন্য সাতজনই পরীক্ষা বর্জন করেনপরে ১৬ জুলাই পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই দিনও এই সাতজন পরীক্ষা বর্জন করেন। কিন্তু ওই দিন লোক দেখানো পরীক্ষানেওয়া হয়। এতে মতিয়ারের পাশাপাশি আরও দুই প্রার্থী অংশ নেন বলে দেখানো হয়। তাঁরা হলেন উপজেলার ধবলসুতি উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আবদুস সোবহান ও হাফিজুর রহমান। অথচ এ দুজনের কেউ ওই নিয়োগের জন্য আবেদনই করেননি।

তবে আবদুস সোবহান দাবি করেন, তিনিসহ সাতজন পরীক্ষার জন্য আবেদন করেই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেনপরীক্ষার ফল পেয়েছিলেন কি না—জানতে চাইলে সোবহান বলেন, তিনি ফল জানেন না।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) প্রতিনিধি হিসেবে পাটগ্রাম সরকারি হুজুর উদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হেলেন আক্তারের কক্ষে ওই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।নিয়মানুযায়ী, পরীক্ষার সময় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বা তাঁর প্রতিনিধিএবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু তাঁদের কেউই উপস্থিত ছিলেন না। এরপরও ২৩ জুলাই মতিয়ারকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয় এবং পরদিন তিনি যোগ দেন।

পরীক্ষা বর্জনকারী সাতজনের একজন আতোয়ার রহমান সরকার বলেন, এই নিয়োগ পরীক্ষার পরতে পরতে অনিয়ম হয়েছে।

তবে মতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমি আবেদন করে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম। এরপর নিয়োগ পেয়েছি; বিদ্যালয়ে যোগদানও করেছি।’

অভিযোগ পেয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু আশরাফ নূর বিদ্যালয়টিরপ্রধান শিক্ষক আজিজার রহমানকে ২৩ জুলাই কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। তিনি গত বুধবার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে জবাব দাখিল করেন।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবু আশরাফ নূর বলেন, ‘আমি জবাব পেয়েছি। তবে সরেজমিন খোঁজখবর নেওয়ার পরই বলা যাবে, প্রধান শিক্ষকের জবাব সন্তোষজনক কি না।’