'বোমা মেশিন' নেই, আছে 'জঞ্জাল'

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথরকোয়ারির পাশে রজ্জুপথের সংরক্ষিত এলাকার দক্ষিণ দিকে বোমা মেশিনের স্থাপনা। এগুলোতে যন্ত্র নেই, অভিযান চালিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। পড়ে আছে শুধু স্থাপনা। গত শনিবার বিকেলে তোলা ছবি l প্রথম আলো
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথরকোয়ারির পাশে রজ্জুপথের সংরক্ষিত এলাকার দক্ষিণ দিকে বোমা মেশিনের স্থাপনা। এগুলোতে যন্ত্র নেই, অভিযান চালিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। পড়ে আছে শুধু স্থাপনা। গত শনিবার বিকেলে তোলা ছবি l প্রথম আলো

চারদিকে বড় বড় পাইপ সাঁটানো, তাতে আছে লোহার খাঁচা, উঁচু বাঁশের আড় ও পানির ওপর ভাসমান খালি ড্রাম। নেই শুধু ‘বোমা মেশিন’ নামের অবৈধ যন্ত্র। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথরকোয়ারিসংলগ্ন রজ্জুপথের (রোপওয়ে) সংরক্ষিত এলাকার দক্ষিণ দিকে গত শনিবার গিয়ে দেখা গেল এ চিত্র।

বোমা মেশিন স্থাপনা অপসারণে কাজ করছিলেন রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) কয়েকজন সদস্য। তাঁদের সঙ্গে দৈনিক মজুরিতে কাজ করছিলেন আরও দুজন শ্রমিক। এসবকে ‘মহা জঞ্জাল’ বলে বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন তাঁরা। উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে গত প্রায় পাঁচ মাসে সর্বোচ্চসংখ্যক টাস্কফোর্সের অভিযান হওয়ায় ভোলাগঞ্জসহ আশপাশ এলাকায় শুধু এ রকম জঞ্জালই বেশি দেখা যাচ্ছে।

সিলেট অঞ্চলের পাথরকোয়ারিগুলোতে বোমা মেশিন নামের পাথর উত্তোলনযন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। মাটির প্রায় ৪০ থেকে ৬০ ফুট গভীর থেকে পাথর উত্তোলন করায় ভূমিধসের আশঙ্কায় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সাল থেকে উচ্চ আদালত বোমা মেশিনসহ যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে টাস্কফোর্স গঠন করে অভিযান চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।

কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথরকোয়ারি মূলত সীমান্ত থেকে নেমে আসা ধলাই নদের উৎসমুখকেন্দ্রিক। প্রায় ১৫৭ একর বিস্তৃত পাথরকোয়ারি। এক পাশে পড়েছে ১৯৬০ সালে নির্মিত রজ্জুপথের সংরক্ষিত এলাকা। প্রায় ৩০০ একর আয়তনের রজ্জুপথের জায়গার একাংশ যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি করে যন্ত্র দিয়ে চলছিল পাথর উত্তোলন। একইভাবে শাহ আরেফিন টিলাও বসতি এলাকায় যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলন চলে। এতে শ্রমিক হতাহতের ঘটনায় গত মার্চ মাসের শুরুতে পুলিশও প্রশাসনের রদবদল করে শুরু করা হয় টাস্কফোর্সের অভিযান।

উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে টাস্কফোর্স মূলত উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গঠন করা হয়। যন্ত্র দিয়ে পাথর উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে অন্তত চারটি অভিযান চালানোর নির্দেশনা ছিল। ২০১০ সাল থেকে আদালতের এই নির্দেশনা পালনে প্রতিবছর ৪৮টি অভিযান চলেছিল। এবার মার্চ থেকে জুলাই (গতকাল) পর্যন্ত পাঁচ মাসে ৩৯টি অভিযান হয়েছে।

টাস্কফোর্স সূত্র জানায়, ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, উৎমা, মাঝেরগাঁও এলাকায় টাস্কফোর্সের ৩৯টি অভিযানে ৪৬৪টি বোমা মেশিন পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। এর মধ্যে বড় আকারের যন্ত্র হওয়ায় ১৫টি জব্দ করা হয়েছে। অবৈধ যন্ত্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ১১ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে শাহ আরেফিন টিলা কেটে গর্ত করায় দুটি খননযন্ত্র (এস্কাকাভেটর), ১৫টি ট্রাক্টর ধ্বংস ও দুটি জব্দ করা হয়। টিলা এলাকায় ভূমিধসের ঝুঁকিতে বসবাসরত ১০টি শ্রমিক পরিবারকে নিরাপদে সরানো হয়েছে।

গত শনিবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রজ্জুপথ এলাকার আশপাশসহ পাথরকোয়ারি এবং ধলাই নদের তীর থেকে কোম্পানীগঞ্জ সদর পর্যন্ত যন্ত্রের জঞ্জাল দেখা গেছে।

বিরাটাকার গর্তের পানিতে ভাসমান অবস্থায় যন্ত্র চালু করতে ১৬ থেকে ৩৬টি খালি ড্রামের সঙ্গে বাঁশ বাধা দেখা যায়। ড্রামের সঙ্গে বড় পাইপ সংযুক্ত করতে তীরে বাঁধা বাঁশের মাচাও শক্ত করে বাঁধা। অভিযানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এগুলো স্থাপনে পারদর্শী একশ্রেণির শ্রমিক আছেন, যাঁরা অতি দ্রুত স্থাপন ও অপসারণ করতে পারেন। বোমা মেশিনচালকের সঙ্গে এই শ্রমিকেরা জড়িত থাকায় অভিযানকালে তাঁদের আর পাওয়া যায় না। এ কারণে অভিযান চলাকালে যন্ত্র তাৎক্ষণিক ধ্বংস করা হলেও স্থাপনা অপসারণ বিলম্বিত হয়।

শনিবার বিকেলের দিকে রজ্জুপথ সংরক্ষিত এলাকার দক্ষিণ দিকের একটিচ গর্তের চারদিকে ২৯টি পাইপ অপসারণ করছিল আরএনবির সঙ্গে দুজন শ্রমিক। জানালেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ২৯টির মধ্যে শুধু নয়টি অপসারণ করতে পেরেছেন। বাকিগুলো অপসারণে আরও দুই দিন লাগতে পারে।

বাঁশ, ড্রামসহ যাবতীয় স্থাপনা অপসারণ করা গেলেও পাইপ অপসারণ কষ্টসাধ্য বলে জানিয়েছেন আরএনবির সদস্যরা। তাঁরা উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ করে বোমা মেশিনের গর্ত ঢেকে ফেলতে পাইপ ব্যবহারের চিন্তা-ভাবনা করছেন।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আবুল লাইছও স্বীকার করেন, এগুলো জঞ্জালের মতো দেখাচ্ছে। কারণ একসঙ্গে এতগুলো অভিযান হওয়ায় সবগুলো দ্রুত অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ইউএনও বলেন, ‘আগে মাসে আদালত নির্দেশিত চারটি অভিযানই হতো। তখন অবৈধ যন্ত্র জব্দ বা ধ্বংস করার সঙ্গে স্থাপনাও অপসারণ সম্ভব হতো। গত তিন মাসে আমরা রেকর্ডসংখ্যক অভিযান করেছি। কোনো মাসে ১৭টিও করেছি। এ জন্য জঞ্জাল দেখাচ্ছে। তবে দেরি হলেও জঞ্জাল পরিষ্কার করা হবে।’