জাপানি তরুণের হৃদয়ে বাংলাদেশ

সম্পর্কটা ১০ বছরের। এক দেখাতেই প্রেম যাকে বলে, সুনসকে মিজুতানির ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। দেশে ফিরে গিয়েও ভুলতে পারেননি। চেহারাটা ভেসে উঠত। চলে এসেছেন। সেই প্রেমকে পরিণত রূপ দিতেই কাজ করছেন অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র নিয়ে।

গত মাসের ২ তারিখ জাপানের জাতীয় দৈনিক দ্য মেইনিচিতে সুনসকে মিজুতানি সম্পর্কে একটি খবর ছাপা হয়। ঢাকার ঠিক কোথায় কাজ করেন, তার উল্লেখ ছিল না। শুধু ‘পদ্মা স্টুডিও’ নামটি ছিল। কিন্তু রাজধানীর অলিতে-গলিতে পাসপোর্ট আকারের ছবি তোলার বহু স্টুডিও আছে ‘পদ্মা’ নামে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভর করে খুঁজে পাওয়া যায় সুনসকেরই আরেক সহযোগী মোতালিব রহমানকে।
মিরপুর ২ নম্বরে এই স্টুডিও। মোতালিবের সঙ্গে স্টুডিওতে ঢোকার পরেই ছোটখাটো গড়নের জাপানি এক ভদ্রলোক হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। হঠাৎ বাংলায় মোতালিবকে কিছু একটা বললেন। সরাসরিই জিজ্ঞেস করে বসা, ‘আপনি বাংলা জানেন?’ কিছুটা জাপানি উচ্চারণে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘বাংলা শিখছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোর্স করেছিলাম, কিন্তু খরচের জন্য শেষ করতে পারিনি।’ এরপর পুরো আলাপই চলল বাংলাতে।
সুনসকের জন্ম জাপানের নারা শহরে। মা-বাবা ও ছোট ভাই আছেন। সেখানেই থাকেন তাঁরা। আইসিটির নিয়ে পড়েছেন জাপানের কানসাই বিশ্ববিদ্যালয়ে। আগ্রহের বিষয় ছিল শিক্ষা, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও মাল্টিমিডিয়া। বললেন, জাপানের সবাই ছবি আঁকে। ছোট থেকে তিনিও ছবি আঁকতে পছন্দ করেন। সেই সঙ্গে মিউজিক। ১৫ বছর বয়স থেকেই মিউজিক কম্পোজ করতে শিখেছেন।
বাংলাদেশে প্রথমবার এসেছেন ২০০৭ সালে। ছিলেন ১০ দিন। ঢাকা ছাড়াও গ্রাম দেখেছিলেন। ভালো লেগে যায়। জাপানের বাইরে প্রথম তিনি বাংলাদেশেই এসেছিলেন। এরপর নেপাল, চীন, ভারতসহ নানান দেশ ঘুরলেও মনে গেঁথে যায় বাংলার ছবি। বলা যায়, প্রেমেই পড়েন। সুনসকে বলেন, ‘এ দেশের মানুষের হসপিটালিটির (আতিথেয়তার) খ্যাতি সারা বিশ্বেই আছে। এটা কেউই ভুলতে পারবে না। প্রথম যখন এসেছিলাম, তখন বিদেশি দেখলে কথা বলার জন্য মানুষের ভিড় জমে যেত। এই ফ্রেন্ডশিপটা আমাকে ভাবাত। আবার আসি।’
শুরুতে এসে বেসরকারি সংগঠন ‘একমাত্রা’তে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছেন। এখনো একমাত্রার সঙ্গে স্টুডিওর কাজ হয়। এরপরে কয়েকবার আসেন। তবে ২০১৪ সালে থেকে আছেন টানা। ভিসার কাজে মাঝেমধ্যে যেতে হয়। সে সময়ই গড়ে তোলেন ‘স্টুডিও পদ্মা’।
একটি কক্ষে কিছু কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবসহ কিছু জিনিস নিয়ে স্টুডিও বসিয়েছেন। তবে এ স্টুডিওতে ছবি তোলা হয় না। তৈরি হয় অ্যানিমেশনের ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ। সুনসকে বলেন, ‘জাপানে অনেক অ্যানিমেশন তৈরি হয়। কিন্তু এ দেশে সেই তুলনায় কম। তবে সুযোগ অনেক।’ সুনসকের সঙ্গে ছয়জন কাজ করেন। তিনি বাকিদের কাজ শেখান। তাঁরাও এখন বিভিন্ন অ্যানিমেশন তৈরি করছেন।

সুনসকের সঙ্গে কয়েকজন বাংলাদেশি ছেলেমেয়ে অ্যানিমেশন তৈরির কাজ শেখার পাশাপাশি তৈরিও করছেন। ছবি: আশরাফুল আলম
সুনসকের সঙ্গে কয়েকজন বাংলাদেশি ছেলেমেয়ে অ্যানিমেশন তৈরির কাজ শেখার পাশাপাশি তৈরিও করছেন। ছবি: আশরাফুল আলম

সুনসকে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। জাপান বা কোরিয়া থেকে পরিচিতজনেরা তাঁকে ফরমাশ দিয়ে থাকেন। মূলত পাঠ্যবইয়ের অ্যানিমেশন বা স্কুলের প্রমোশনাল ভিডিও করেন। বাংলাদেশের জন্য কাজ করার ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ তেমন হয়নি। তবু নিজে কিছু বানিয়েছেন। নিজেদের ইউটিউব চ্যানেল থেকে দেখালেন দুটি ভিডিও। একটি ওয়েব বিজ্ঞাপন বানিয়েছেন ঢাকার এক জাপানিজ রেস্তোরাঁর জন্য। বাঘ আর শিয়াল নিয়ে আরেকটি অ্যানিমেশন ভিডিও বানাবেন। তার স্কেচ চলছে।
জাপানে এত সুযোগ থাকতে বাংলাদেশে কেন? সুনসকে বলেন, ‘এখানে অ্যানিমেশন তৈরির ক্ষেত্রটা বড়। সবার ব্যবহার আমার খুব ভালো লাগে। একটি টিউবওয়েল চেপে যখন পানি বের করা হয়, তখন তার হাতের মুভমেন্ট নিয়ে সুন্দর অ্যানিমেশন করা যায়, যা জাপানে নেই।’ তিনি এখানকার সংস্কৃতির নানান ভিন্নতার প্রশংসা করলেন। বললেন, ‘কালচার দিনে দিনে পরিবর্তন হয়। এর মধ্যেই অনেক কিছু নাই হয়ে গেছে। রিকশা এখন আমরা যেভাবে দেখতে পাচ্ছি, ১০ বছর পরে হয়তো এমনটা না-ও থাকতে পারে। অ্যানিমেশনের মাধ্যমে এগুলোকে সুন্দর করে রাখা সম্ভব।’
বাংলাদেশে অ্যানিমেশনের অবস্থা নিয়ে সুনসকে বলেন, এ দেশে অ্যানিমেশন জগতের তেমন কোনো হিরো নেই। ‘মীনা’র কথা উল্লেখ করলেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভিনদেশের কার্টুন বেশি জনপ্রিয়, তা-ও জানেন। সুনসকের ইচ্ছা বাংলা ভাষায় বাংলা সংস্কৃতির গল্প নিয়ে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তৈরি করা, যা তৈরি হবে বাঙালিদের হাতেই। সে লক্ষ্যেই এ দেশের কিছু ছেলেমেয়ে নিয়ে কাজ করছেন।
সুনসকের সঙ্গে শুরু থেকেই আছেন মোতালিব রহমান। তিনি স্টুডিও পদ্মার সহযোগী পরিচালক। মোতালিব বলেন, এ দেশে অ্যানিমেশনের ভবিষ্যৎ ভালো। কিন্তু টাকার দিক থেকে সহযোগিতা কম পাওয়া যায়। স্টুডিওতে আরও কয়েকজন কাজ করছিলেন। এর মধ্যে পাশেই বসে স্নাহাল সিংহ সাদা কাগজে স্কেচ করছিলেন। সবার লক্ষ্যই অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তৈরির।
নিজে জাপানি, কিন্তু স্টুডিওর নাম পদ্মা কেন? মজার এক গল্প শোনালেন। সুনসকের দাদি বৌদ্ধদের এক মন্ত্র পড়তেন। ছোট থেকে সেটা শুনেছেন। সেখানে একটা শব্দ আছে ‘হানদোমা’। শব্দটা তাঁর পছন্দের। তাঁর কাছে মনে হয়েছে উচ্চারণে ‘পদ্মা’র সঙ্গে মিল রয়েছে। সেখান থেকেই এই নাম। তবে তিনি জানেন, পদ্মা এ দেশের অন্যতম প্রধান বড় নদী। এ ছাড়া পদ্ম ফুলও তাঁর পছন্দ।

জাপানি নাগরিক সুনসকে মিজুতানির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা দীর্ঘদিনের। স্বপ্ন বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তৈরি করবেন। ছবি: আশরাফুল আলম
জাপানি নাগরিক সুনসকে মিজুতানির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা দীর্ঘদিনের। স্বপ্ন বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র তৈরি করবেন। ছবি: আশরাফুল আলম

ছবি আঁকা ছাড়াও সুনসকের গানের প্রতি আগ্রহ অনেক। নিজে পিয়ানো বাজান। জানালেন, ‘বাজনবিদ’ নামে একটি ব্যান্ড আছে। বাংলাদেশেই আরেক জাপানি বন্ধুর সঙ্গে মিলে এই ব্যান্ড তৈরি করেছেন। বাংলাদেশের লালনগীতি, রবীন্দ্রসংগীত তাঁর পছন্দ। হাতে একটি কাগজ নিয়ে বললেন, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটি শেখার চেষ্টা করছেন। শুরুতে মসলাদার বাংলা খাবার খেয়ে ভুগেছেন ডায়রিয়ায়। তবে এখন সয়ে গেছে। এ দেশের মাছ ভীষণ সুস্বাদু। উল্লেখ করলেন রুই, ইলিশ ও তেলাপিয়ার নাম।
নিজ দেশে গিয়ে যখন বাংলাদেশের কথা বলেন, অনেকেই চেনে না। সুনসকের খারাপ লাগে। সেখানে তিনি এ দেশের আতিথেয়তার গল্প করেন। বললেন, ‘দুই দেশের মধ্যে ব্রিজ হিসেবে কাজ করতে চাই।’ সুনসেকা বাংলা পড়তে ও লিখতে পারেন। ফেরার আগে সুনসকে পিয়ানো বাজিয়ে গেয়ে শোনালেন, ‘আমি বাংলায় গান গাই...’। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতার মতো সুনসকে নিজেকে বাংলাতেই খুঁজে পেয়েছেন।