দৃষ্টি হারাচ্ছেন সিদ্দিকুর?

ভারতের চেন্নাইয়ের শঙ্কর নেত্রালয়ে চিকিৎসাধীন িসদ্দিকুর l ছবি: সংগৃহীত
ভারতের চেন্নাইয়ের শঙ্কর নেত্রালয়ে চিকিৎসাধীন িসদ্দিকুর l ছবি: সংগৃহীত

ঠিক ১৬ দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের সবশেষ প্রোফাইল পিকচার দিয়েছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। পরনে সাদা পাঞ্জাবি, মুখে হাসি। ফেসবুকে সিদ্দিকুরের সেই ছবিটি এখনো আছে। নেই শুধু চোখের দৃষ্টি। ভার্চ্যুয়াল বা বাস্তব জগৎ কোনোটাই আর দেখবেন না সিদ্দিকুর।

দেশে থাকতেই ডান চোখের দৃষ্টি হারানোর সংবাদ দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। বাঁ চোখের দৃষ্টি ফেরার ক্ষীণ আশা নিয়ে সিদ্দিকুরকে পাঠানো হয়েছিল ভারতের চেন্নাইয়ের শঙ্কর নেত্রালয়ে। গতকাল সোমবার সেখানকার চিকিৎসক চোখ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানিয়েছেন, অস্ত্রোপচারে বাঁ চোখের দৃষ্টি ফেরার সম্ভাবনাও নেই।

গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে সিদ্দিকুরকে চেন্নাইয়ে নেওয়া হয়। শুক্রবার সেখানকার চিকিৎসক ধনশ্রী রাত্রা চোখ পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, চোখের ভেতরের আঘাত গুরুতর। অস্ত্রোপচারে যাওয়া ঠিক হবে কি না, এ জন্য তিনি দ্বিতীয় মতামতের জন্য চিকিৎসক লিংগম গোপালের কাছে রেফার করেছিলেন। গতকাল লিংগম গোপাল তাঁর মতামত জানান, অস্ত্রোপচারেও সিদ্দিকুরের চোখের দৃষ্টি ফিরবে না।

চিকিৎসকের এই মতামতে শঙ্কর নেত্রালয় থেকে হোটেলে ফিরে কেবলই কাঁদছিলেন সিদ্দিকুর। খোঁজ নিতে বন্ধুরা যখন সঙ্গে থাকা তাঁর বড় ভাইয়ের মুঠোফোনে খোঁজ নিচ্ছিলেন, কান্নার দমকে সিদ্দিকুর তখন কথা বলতে পারেননি। দীর্ঘক্ষণ পর কিছুটা স্বাভাবিক হলে কথা বলেন তাঁর সহপাঠী ও বন্ধু শেখ ফরিদের সঙ্গে। ফরিদ প্রথম আলোকে বলেন, সিদ্দিকুর ও সঙ্গে থাকা বড় ভাই নায়েব আলীর সঙ্গে মেসেঞ্জারে তাঁর কথা হয়েছে। অস্ত্রোপচার করেও কিছু হবে না—চিকিৎসক এ কথা জানানোর পর দীর্ঘক্ষণ কক্ষে বসে কান্নাকাটি করেছেন সিদ্দিকুর। তাঁরা ভেঙে পড়েছেন। সিদ্দিকুর সবার দোয়া চেয়েছেন।

সিদ্দিকুরের সঙ্গে আছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক জাহিদুল আহসান। তিনি সামাজিক
যোগাযোগমাধ্যমে প্রথম আলোর কাছে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, ‘আমি ডাক্তারের রিপোর্ট এবং মতামত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। পরবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছি।’

তবে গতকাল বিকেলে শেখ ফরিদ প্রথম আলোকে বলেন, সিদ্দিকুরের সঙ্গে তাঁর আবারও কথা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১ শতাংশেরও কম আশা আছে। রোগী চাইলে মানবিক দৃষ্টিতে অস্ত্রোপচার করা হবে। সিদ্দিকুর বলেছেন, চেন্নাই যেহেতু গিয়েছেন, তিনি অস্ত্রোপচার করে দেখতে চান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজের সময়সূচিসহ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবিতে গত ২০ জুলাই শাহবাগে আন্দোলনে গিয়ে ‘পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের শেলের’ আঘাতে সিদ্দিকুরের দুই চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটনার দিনই তাঁকে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সিদ্দিকুরের দুই চোখে অস্ত্রোপচার হয়। এর পরেই ওই হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ইফতেখার মো. মুনির প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘অস্ত্রোপচারের পর সিদ্দিকুর রহমান তাঁর ডান চোখে কোনো আলো দেখছেন না। বাঁ চোখে এক দিক থেকে আলো ফেললে আলোর উপস্থিতি টের পাচ্ছেন।’

সিদ্দিকুরের ফেসবুক আইডিটি তাঁর সহপাঠীরা এখন ব্যবহার করছেন তাঁর সবশেষ খোঁজখবর জানাতে। তাঁদের সঙ্গে তোলা সিদ্দিকুরের পুরোনো ছবি দিচ্ছেন। ছবিগুলো দেখে প্রাণবন্ত হাসিমুখের একজন সিদ্দিকুরকেই খুঁজে পাওয়া যায়। তিন বছর বয়সে বাবা হারানো যে ছেলেটির পরিকল্পনা ছিল বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরির। পরিবারের হাল ধরতে মাকে যিনি আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।

শাহবাগে আন্দোলনের সেই দিনের বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সবগুলোতেই দেখা যায়, পুলিশের একজন সদস্য খুব কাছ থেকে টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করছেন। আর মুহূর্তেই ভূপাতিত হচ্ছেন সিদ্দিকুর। তাঁর রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে রাস্তা।

ঘটনা তদন্তে পুলিশের দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। সময় দেওয়া হয়েছিল তিন দিন। তবে দুটি কমিটিই সেই সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা না দিয়ে তাদের সময় বাড়িয়ে নিয়েছে। একটি কমিটি বাড়িয়েছে সাত দিন, অন্যটি তিন দিন।