'কোনটে যামো, কী খামো'

টিকলাই টুডু (৭০)। দিনাজপুরের সদর উপজেলার শংকরপুর ইউনিয়নের বরাইপুর গ্রামের বাসিন্দা। বন্যায় বাড়ি ধসে যাওয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়কের পাশে এক দোকানের বারান্দায়। ছবিটি গতকাল দুপুুরে তোলা l প্রথম আলো
টিকলাই টুডু (৭০)। দিনাজপুরের সদর উপজেলার শংকরপুর ইউনিয়নের বরাইপুর গ্রামের বাসিন্দা। বন্যায় বাড়ি ধসে যাওয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়কের পাশে এক দোকানের বারান্দায়। ছবিটি গতকাল দুপুুরে তোলা l প্রথম আলো

টিকলাই টুডু (৭০)। দিনাজপুরের সদর উপজেলার শঙ্করপুর ইউনিয়নের বরাইপুর গ্রামের বাসিন্দা। বছর দশেক আগে স্বামী মারা যান। থাকেন বড় ছেলে বাবুরাম হেমব্রমের সঙ্গে। বাবুরাম কৃষিশ্রমিক। তাঁদের কোনো জমিজমা নেই। গত তিন দিনের বর্ষণে বাড়িঘরে পানি ওঠায় পরিবারসহ টিকলাই আশ্রয় নিয়েছেন দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়কের পাশে ইউনিয়নটির আমবাগান মোড় এলাকায় একটি দোকানের বারান্দায়।

গতকাল সোমবার বেলা একটায় ওই দোকানঘরের বারান্দায় বসে আনমনে কচুমুখি ছুলছিলেন টিকলাই টুডু। এই প্রতিবেদক সেখানে গেলে তিনি বলেন, ‘খাবার নিয়াইছেন নাকি? শনিবারোত তে এই বারান্দাত আছি কেউ এনা খাবার দিল না। বানোত হামার সব ডুবি গেছি। বাড়িঘর পানিত মিশে গেছি। হারা এখন কোনটে যামো, কোটে থাকমো, কী খামো। হামাক ঘর বানে দিবে কে?’

টিকলাই টুডুর মতো একই .অবস্থা ডুপরি সরেনের (৫৫)। তাঁরও স্বামী নেই। নেই জমিজমা। ছেলের সঙ্গে কৃষিশ্রমিকের কাজ করে কোনো রকমে দিন যায়। বন্যার পানিতে বাড়িঘর ধসে গেছে তাঁদেরও।

টিকলাই ও ডুপরির মতো বরাইপুর গ্রামের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ১৫টি পরিবার আমবাগান মোড়ে বিভিন্ন দোকানের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে। ওই সব পরিবারের কয়েকজন বলেন, গত শনিবার সকালে তাঁরা আমবাগান মোড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত তাঁদের কেউ খোঁজখবর নেয়নি।

দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ মহাসড়কের পাশে চিরিরবন্দর উপজেলার আমতলী উচ্চবিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে চকমুশাই গ্রামের প্রায় এক শটি পরিবার। এখানে আশ্রয় নেওয়া মর্জিনা বেগম ও মোহাসেনা খাতুন বলেন, তাঁদের জমিজমা নেই। তাঁরা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। স্বামীরা কৃষিশ্রমিক। এভাবে কোনো রকমে চলে তাঁদের জীবন। বন্যায় মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে অন্ধকার দেখছেন তাঁরাও।

একই স্থানে আশ্রয় নেওয়া কয়েকজন বলেন, শনিবার সকালে এখানে আশ্রয় নেওয়ার পর স্থানীয় পুনট্টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শুধু একবার এক মুঠো করে মুড়ি দিয়ে গেছেন। আর কেউ কিছু দেননি। খবরও নেননি।

দিনাজপুর শহরের সরকারি কলেজে আশ্রয় নেওয়া তসলিমা বেগম, গাউসিয়া দাখিল মাদ্রাসা এবং এতিমখানায় আশ্রয় নেওয়া কাশেম আলী, বড় বন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া আইরিন আক্তার, খালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া নজু মিয়া, বিরল উপজেলার দামইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া কোহিনুর বেগমসহ অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। পরিবারের সদস্যদের এখন একটাই চিন্তা—বন্যার পর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলার ৩২০টি আশ্রয়কেন্দ্রে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছেন। এর বাইরে আরও প্রায় ১০ হাজার ব্যক্তি বিভিন্ন স্থানে ঠাঁই নিয়েছেন। বন্যায় কী পরিমাণ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এর সঠিক পরিসংখ্যান এখনো নেই।

জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম বলেন, এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদেরও পর্যাপ্ত ত্রাণ দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

শহরের বাইরে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় পর্যাপ্ত ত্রাণ না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে দ্রুত ত্রাণের ব্যবস্থা করা হবে।