'কেউ আমগরে দেখতেও আহেনি'

শোবার ঘরেও বুকপানি। ডুবে গেছে খাট-সিন্দুক সবই। আশপাশে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই ঘরেই মাচা বেঁধে থাকছেন সুবেদা বেগম। কয়েক দিন ধরে এভাবে দিন কাটালেও তাঁদের দেখতে আসেননি কেউই।

সুবেদার বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহউপজেলার ফুলকুচা ইউনিয়নের দিলালেরপাড় গ্রামে। তাঁর মতো অবস্থা গ্রামটির বেশির ভাগ বাসিন্দারই। সব বিদ্যালয়ের ভবনের ভেতর পানি ওঠায় এ উপজেলা এবং এর পাশের মাদারগঞ্জ উপজেলায় কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই।

ওই দুটি উপজেলা শহর ও মেলান্দহের হাজরাবাড়ী বাজার ছাড়া প্রায় সব জায়গাই পানির নিচে। গতকাল বুধবার নৌকা নিয়ে ঘুরে উপজেলা দুটির বানভাসি মানুষের দুর্দশার চিত্র দেখা যায়।

সুবেদা বেগম বলেন, ‘বান হিড়িক দিয়ে হাঁস-চড়াইসহ সবই ভাসায় নিছে। ঘরও ভাঙা গেছে।

আমরার মতো কষ্টে কেউ নাই। খিদায় পোলাপান কানছে। কুঠাও সর মাটি (শুকনা জায়গা) নাই। মাচায় থাকতেছি আর কলার ভুইড়ার (ভেলা) ওপর আলু-ভাত সেদ্ধ করতেছি। বানের মধ্যে থাকলেও কেউ আমগরে দেখতেও আহেনি।’ সুবেদার স্বামী মো. শাজাহান মিয়া ঘোড়ার গাড়ির চালক। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় তিনিও বেকার হয়ে পড়েছেন। ঘরে শুকনা খাবারও নেই।

জানতে চাইলে মেলান্দহ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জন কেনেডি জাম্বিল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে প্রশাসনের কোনো আশ্রয়কেন্দ্র না থাকলেও স্থানীয় কিছু কেন্দ্র রয়েছে। তবে সেগুলোতে লোকজন কম। কিছু এলাকায় নৌকা নিয়ে যাওয়াও দুরূহ হয়ে পড়েছে। এমন কিছু এলাকায় ত্রাণ নিয়ে গিয়ে গতকালও ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছি। তবে আগামীকাল (আজ) এসব এলাকায় অবশ্যই ত্রাণ পৌঁছানো হবে।’

গতকাল সকাল থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত নৌকা দিয়ে মেলান্দহের বামুনপাড়া, দিলালেরপাড়, আদিয়ারপাড়া ও চর আদিয়ারপাড় এবং মাদারগঞ্জের জোটিয়ারপাড়া, গুনারীতলা ও মহিষবাথান গ্রামে ঘুরে মানুষের দুর্ভোগের চিত্র দেখা যায়। এসব এলাকার সব রাস্তার ওপর তীব্র¯স্রোত। হেঁটেও পারাপার হওয়া যাচ্ছে না। অনেকে নৌকা খুঁজেও পাচ্ছেন না। কয়েকটি নৌকা থাকলেও অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।

এ সময় মাদারগঞ্জ পৌর শহরের বাসিন্দা জুলফিকার আলী বলেন, এত বড় বন্যা মানুষ আগে দেখে নাই। এরপরওসরকারি কোনো সাহায্য নেই।

জোটিয়ারপাড়া গ্রামের হরবলা বেগম বলেন, ‘তিন দিন ধরে ওপর দিইয়া বান যাইতেছে। কেউ খবর পর্যন্ত লইতে আহে নাই। এক ছটাক ত্রাণও পাইনি। এমন কষ্ট আগে কহনো হয়নি। হিড়হিড়ি পানি বাড়ছে। পোলাপান নিয়ে কোথায় যামু। আমগর সাহায্য না দিলে মরতে হবে।’

গত সোমবার থেকে জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। মেলান্দহ ও মাদারগঞ্জের সব ইউনিয়ন, ইসলামপুরের ১২টির মধ্যে ১০টি ইউনিয়ন, সদরের কিছু অংশ, দেওয়ানগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও বকশীগঞ্জসহ পুরো জেলায় ছয় লাখ মানুষ এখন বন্যাকবলিত। এর মধ্যে মাদারগঞ্জ উপজেলার অবস্থা বেশি খারাপ। উপজেলাটির সঙ্গে জেলা শহরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে পুরো উপজেলা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। মাদারগঞ্জ পৌর শহরের দোকানপাটের মালামালও শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই অনেকে টাকা দিয়েও শুকনা খাবার পাচ্ছে না।

মাদারগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, এ উপজেলায় মঙ্গলবার ২০ মেট্রিক টন চাল ও গতকাল বুধবার ১৬ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ কার্যক্রম চলছে। তবে উপজেলার সঙ্গে সব স্থানের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ত্রাণ বিতরণে কিছু ভাটা পড়েছে। পৌর শহরের যেসব দোকানে শুকনা খাবার ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। এ কারণে দুর্গত এলাকায় শুকনা খাবার বিতরণ করা যাচ্ছে না। তবে বিকল্প হিসেবে বগুড়া থেকে খাবার কেনার পরিকল্পনা চলছে।