বাউল সম্রাটের আত্মীয়দের দিনরাত্রি

আপা, মা কবে বাড়ি আসবে? রাতে ঘুমানোর আগে ছোট্ট ভাইয়ের কাছ থেকে এমন প্রশ্ন প্রায়ই তাকে শুনতে হয়। ছোট্ট ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বড় বোন বলে, ‘মা শিগগিরই বাড়ি আসবে। তোমায় কোলে নিয়ে ঘুমাবে।’ 

বড় বোন ভালো করেই জানে, বাবা-মা কাজের জন্য এখন ঢাকায় আছেন। গত চৈত্র মাসে সুনামগঞ্জের হাওরে ফসলডুবির পর বৈশাখে বাড়ি ছাড়েন তাঁরা। কাজের খোঁজে চলে আসেন ঢাকায়। গত রোজার ঈদেও বাড়ি আসেননি।সাত বছরের হাবিব মিয়ার বড় বোনের নাম সুরমা বেগম। তার বয়স দশ বছর। এই দুই শিশু বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের আত্মীয়। বাউলসম্রাটকে তারা ‘বড় বাবা’ বলে ডাকত। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের উজানধলে বাউলসম্রাটের বাড়ির পাশেই তাদের ঘর। শাহ আবদুল করিমের পাঁচ বোনের একজন ফুলজান বিবি। তাঁর ছেলে আবদুল ওয়াহেদের মেয়ে রুপছা বেগমের ঘরে তাদের জন্ম। 

বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের সম্পর্কে নাতি ছোট্ট হাবিব আর সুরমা। ছবি: আসাদুজ্জামান
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের সম্পর্কে নাতি ছোট্ট হাবিব আর সুরমা। ছবি: আসাদুজ্জামান

চলতি বছর হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়। এর মধ্যে ১৫৪টি হাওরের ধান তলিয়ে যায় পানিতে। সরকারি হিসাব বলছে, পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। নয় দিন সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, ফসলডুবির পর ঋণগ্রস্ত অনেকে কাজের সন্ধানে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরে চলে গেছেন। অনেকের বাড়িঘরে তালা মারা। অনেকে ছোট শিশুদের রেখে গেছেন আত্মীয়স্বজনদের কাছে। 
৫ আগস্ট বিকেলে হাওরের জলরাশি যেন নীল সমুদ্র হয়ে ওঠে। দিরাই উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামের নৌকাঘাট থেকে ট্রলারযোগে হাওরপারে

বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের বাড়ি। ছবি: আসাদুজ্জামান
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের বাড়ি। ছবি: আসাদুজ্জামান

র গ্রাম উজানধলের বাউলসম্রাটের বাড়িতে যাওয়া। উঠোনের ঠিক মাঝখানে বাঁশের চটা দিয়ে ঘেরা বেড়া। ওপরে টিনের চালা। ঘরের মধ্যে দুটি কবর। একটি বাউলসম্রাটের, আরেকটি তাঁর স্ত্রীর। উঠানে কথা হয় শাহ আবদুল করিমের একমাত্র ছেলে শাহ নূর জালালের সঙ্গে। হাওরের ফসলডুবির কথা বলতে গিয়ে বাবা-মা ছেড়ে একা একা ছোট্ট সুরমা আর হাবিবের কষ্টের দিনরাত্রির গল্প শোনাতে শুরু করেন। এরপর একসময় ওই দুই শিশুও আসে সেখানে।

বাড়ির উঠানে এই ঘরেই চিরনিদ্রায় শায়িত বাউলসম্রাট ও তাঁর স্ত্রী। ছবি: আসাদুজ্জামান
বাড়ির উঠানে এই ঘরেই চিরনিদ্রায় শায়িত বাউলসম্রাট ও তাঁর স্ত্রী। ছবি: আসাদুজ্জামান

রোজ ঢাকা থেকে মা রুপছা মুঠোফোনে কথা বলেন। হাবিবের আহাজারির কথা বলে ছোট্ট সুরমা যখন মায়ের কাছে জানতে চায়, মা বাড়ি ফিরে আসবেন কবে? তখন মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। মায়ের কান্না শুনে সুরমাও তখন কাঁদতে থাকে। মা-বাবা চলে যাওয়ার পর তারা দাদি নুরুন্নেছার কাছে ঘুমায়। দাদির বাড়ি হবিগঞ্জে। তিনি বাউলসম্রাটের বড় একভক্ত। কয়েক বছর আগে থেকে তিনি এখানে থাকেন। বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকা নাতি-নাতনির কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে মায়ের জন্য হাবিবের রোজকার হাহাকার তাঁর মনকে কাঁদায়। আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে শিশুটিকে কোলে তুলে নেন।

বাড়ির সামনে হাওরের চিত্র। ছবি: আসাদুজ্জামান
বাড়ির সামনে হাওরের চিত্র। ছবি: আসাদুজ্জামান

নুরুন্নেছা বলেন, মেয়ে সুরমাকে বাড়িতে রেখে গেলেও ছেলে হাবিবকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় যান তাদের বাবা-মা। হাবিবের মা কাজ নেন একটি গার্মেন্টসে। আর বাবা রাজমিস্ত্রির। দিন-পাঁচেক হাবিবকে তার মা কারখানায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাজের চাপে ছেলেকে সময় দিতে পারতেন না। সে কেবলই কাঁদত। এর দশ-পনেরো দিনের মাথায় হাবিবকে আবার গ্রামে রেখে যান তাঁরা। সেই থেকে হাবিব গ্রামে থাকে।

সুরমা ও হাবিব পড়ে বাউলসম্রাটের গ্রামের স্কুল উজানঢল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিশু শ্রেণির ছাত্র হাবিবের ছুটি হওয়ার পরও সে বোনের কাছেই থাকে। বোনের পিছু সে ছাড়ে না। যত আবদার তার ওই বোনের কাছেই। দোকান থেকে তাকে কিনে দিতে হয় প্রিয় চকলেট। জন্মের পর কোনো দিন মাকে ছেড়ে একা থাকা হয়নি তাদের। এবারের হাওরের ফসলডুবির পর সেটাই থাকতে হচ্ছে। এই দুটি শিশুও বলতে থাকে, হাওরের ধান যদি পানিতে না ডুবত তাহলে হয়তো তাদের মাকে ছেড়ে এভাবে থাকতে হতো না। বাবা-মাকে ছেড়ে একা একা থাকতে বড় কষ্ট হচ্ছে তাদের। মন খারাপ থাকে।

ঘরের ভেতর বাউলসম্রাটের ব্যবহৃত খাট। ছবি: আসাদুজ্জামান
ঘরের ভেতর বাউলসম্রাটের ব্যবহৃত খাট। ছবি: আসাদুজ্জামান

বাউলসম্রাটের দুখু এখন বড়ই দুঃখী: বছর ত্রিশের দুখু মিয়া সম্পর্কে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের নাতি। তাঁর নানি বাউলসম্রাটের আপন বোন। ছোটবেলা থেকে বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন। ডাকতেন নানা বলে। তিনি যেখানে গান করতে যেতেন, সেখানেই তাঁকে নিয়ে যেতেন। বাউলসম্রাটের সঙ্গে থাকতে থাকতে তাঁর প্রায় ১৫০টি গান মুখস্থ। বাউলসম্রাটের ভক্তদের গান শুনিয়ে তিনি আনন্দ পান। তাঁরা যা খুশি হয়ে দেন, তাই হাত পেতে নেন। গানের পাশাপাশি মাছের সময় মাছ ধরে আর ধান কাটার সময় ধান কেটে যে আয় হতো, তা দিয়ে দিব্যি তাঁর সংসার চলে যেত। কিন্তু এবার হাওরের ফসলডুবির পর সংসার চালাতে গিয়ে বড় হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। প্রায় প্রতিবছর ধানের সময় অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে বেশ ভালো রোজগার করতেন। সেই টাকায় দশ-বিশ মণ ধান কিনে রাখতেন। কিন্তু এবার ঘরে ধান নেই। এখন হাওরে মাছ ধরে সংসার চালাচ্ছেন। যেদিন মাছ ধরা পড়ে না, সেদিন বড় কষ্টে যায়। বিবাহিত দুখু মিয়ার দুই সন্তান।

বাউলসম্রাটের একমাত্র ছেলে বাউল শাহ নূর জালাল। ছবি: আসাদুজ্জামান
বাউলসম্রাটের একমাত্র ছেলে বাউল শাহ নূর জালাল। ছবি: আসাদুজ্জামান

দুখু মিয়ার ভাষ্য, মাছ ধরে আর সংসার চালানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। মাঝেমধ্যে এলাকা ছেড়ে ঢাকা চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নানা বাউলসম্রাটের কথা মনে পড়লে গ্রাম ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। ভাবেন, যত কষ্টই হোক, নানার গ্রামেই থাকবেন। গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাবেন না। কিন্তু স্ত্রী আর ছেলেমেয়ের মুখে তিন বেলা খাবার তুলে দিতে বড় কষ্ট হচ্ছে। প্রায় ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। রান্না করার সময় প্রায় স্ত্রী যখন বলে ওঠেন, চাল নেই, তখন মনটা বড় কাঁদে। ফসলডুবির পর দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকা দুখু মিয়া এখনো সকাল-দুপুর বাউলসম্রাটের গান নিয়ে থাকেন। রাতে যখন তাঁর ছোট্ট কুঁড়েঘরে কথা হচ্ছিল, তখন একে একে বাউলসম্রাটের তিনটি গান গেয়ে শোনান দুখু মিয়া। নানার মরমি গান তাঁকে প্রেরণা দেয়, মনে সাহস জোগায়। স্বপ্ন দেখেন, আবার দিন ঘুরবে। বাউলসম্রাটের বিখ্যাত সেই গান ‘দিন হতে দিন, আসে যে কঠিন, করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম… ’।

বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের নাতি দুখু মিয়ার পরিবার। ছবি: আসাদুজ্জামান
বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের নাতি দুখু মিয়ার পরিবার। ছবি: আসাদুজ্জামান