আশ্রয়কেন্দ্রে বানভাসিদের ব্যতিক্রমী কর্মব্যস্ততা

বন্যায় ডুবেছে গ্রাম। গ্রামের বাসিন্দারা আশ্রয় নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। তবুও জীবন থেমে নেই। তাঁরা নেই বসে, কারও সাহায্যের আশায়। আশ্রয়কেন্দ্রে বসেই তাঁরা বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে দুবেলা পেটভরে খাবার খাচ্ছেন।

ব্যতিক্রমী এই দৃশ্য রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ঘনিরামপুর বড়গোলা উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রের।

রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে তারাগঞ্জের ঘনিরামপুর গ্রামে ওই আশ্রয়কেন্দ্রটির অবস্থান। আশ্রয়কেন্দ্রটির উত্তর দিকে যমুনেশ্বরী নদীর ধারে তারাগঞ্জের কুর্শা ইউনিয়নের পাটনীপাড়া গ্রাম। ওই গ্রামের ৫০টি পরিবারের বসবাস। নারী-পুরুষ, শিশু সবাই কমবেশি কর্মজীবী। তাঁরা বাঁশ দিয়ে কুলা, ডালা, খলাই, টুকরি, পলো, মোড়া, ডারকি, মুরগির খাঁচাসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরি করেন। এ জন্য তাঁদের দিন ও রাত কাটে কর্মব্যস্ততায়। পরিবারগুলোর না খেয়ে থাকার কষ্ট নেই।

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার দিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পাটনীপাড়াগ্রামটি আট দিন আগে জলমগ্ন হয়ে পড়ে। ক্রমান্বয়ে পানি বেড়ে দাঁড়ায় বুকসম। হকচকিত গ্রামবাসী ছুটে যান, ওই আশ্রয়কেন্দ্রে। সেখানে গিয়েও তাঁরা বসে নেই। নেই সরকারি-বেসরকারি সাহায্য পাওয়ার আশায়। আশ্রয়কেন্দ্রেও তাঁরা বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এসব বিক্রি করে তাঁদের দিনও চলছে ভালোভাবে।

 সরেজমিনে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা একটায় গিয়ে দেখা যায়, অন্য আশ্রয়কেন্দ্রে অংশ নেওয়া বানভাসিদের মতো তাঁরা কষ্টে নেই। নেই তাঁদের মধ্যে দুমুঠো খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর ওষুধের জন্য হাহাকার। চুপচাপ বসেও ছিলেন না কেউ। নারী-পুরুষ মিলে বাঁশ দিয়ে নানান জিনিস তৈরি করছেন। বসে নেই শিশুরাও। বাবা-মায়ের সঙ্গে তারাও কাজে হাত লাগিয়েছে।

ওই আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বিশ্বনাথ দাস বলেন, ‘দাদা হামরা ভালোয় আছি। ৫-১০ কেজি সরকারি চালের জন্য মেম্বার-চেয়ারম্যানের পেছনোত না ঘুরি হামরা কুলা, ডালা, খলাই, টুকরি, পলো, মোড়া, ডারকি, মুরগির খাঁচা বানাওছি। হাট-বাজারোত বেচে প্রত্যেক দিন দেড়-দুই শ টাকা কামাই করুছি।’

ওই আশ্রয়কেন্দ্রের রামপ্রসাদ দাস বলেন, ‘বন্যায় বাড়ি ডোবছে তা কী হইচে। অ্যাটে কোনা আসিয়াও কাজ করুছি। বসি থাকি কী হইবে। যেটে যামো কর্ম করি খামো। কারও সাহায্যর দরকার নাই। পরিশ্রম দিয়া যা পাই, তাই দিয়া চাল-ডাল কিনে খাই। হামার না খেয়া থাকির কষ্ট নাই।’

তিন সন্তানসহ ওই আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ভবেশ দাস। দেখা গেল বাঁশ দিয়ে ডালা, কুলা তৈরির কাজে তাঁকে স্ত্রীসহ শিশুরাও সহযোগিতা করছে। তিনি বলেন, ‘বাড়িত বসি যে কাম করছি, যা খাছি। অ্যাটে আসিয়াও তাই করুছি, তাই খাওছি। আশীর্বাদ করেন ভালো আছি। তোমরা একনা সরকারোক কন, বন্যাত ভাঙি যাওয়া হামার গ্রামের আস্তা কোনা ঠিক করি দেউক।’

কুর্শা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আফজালুল হক বলেন, অন্য আশ্রয়কেন্দ্রের বানভাসিদের মতো ওই আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষ সাহায্যের জন্য পরিষদে ধরনা দিচ্ছেন না। আশ্রয়কেন্দ্রে বসেই বাঁশের জিনিস তৈরি করেই সংসার চালাচ্ছেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিলুফা সুলতানা বলেন, ‘ব্যতিক্রমী ওই ঘটনাটি অনুকরণীয়। গত বুধবার ওই আশ্রয়কেন্দ্র গিয়ে বানভাসি নারী-পুরুষদের কর্মমুখর দেখেছি। তাঁরা আমার কাছে গ্রামের রাস্তা ঠিক করে দিতে বলেছেন।’