কয়েন দেখলেই বেজার, ব্যাংক থেকে বাজার

কয়েন লেনদেনে প্রায়ই বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে।ফাইল ছবি প্রথম আলো
কয়েন লেনদেনে প্রায়ই বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে।ফাইল ছবি প্রথম আলো

শাহবাগ থেকে ফার্মগেট যাবেন বেসরকারি চাকরিজীবী মো. ফারুক আহমেদ। বাসে উঠে চালকের সহকারীর হাতে পাঁচ টাকার দুটি কয়েন ভাড়া হিসেবে তুলে দেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে তা ফিরিয়ে দিলেন ওই সহকারী। তিনি কয়েন নিতে চান না, এর বদলে দিতে হবে কাগুজে নোট।

চালকের ওই সহকারীর নাম মো. হাবিব। কেন কয়েন নেবেন না, জিজ্ঞেস করতেই নিজের প্যান্টের পকেট থেকে একমুঠো কয়েন বের করে হাবিব বলেন, ‘কয়েন দিয়া কি করমু? আইজকা সকাল থেইকা এইগুলা জমছে। যাত্রীরাই দিছে, কিন্তু নিতে চায় না।’ তিনি আরও বলেন, বাসে ভিড়ের মধ্যে এত কয়েন নিয়ে চলাফেরা করা ঝামেলা, রাখার জায়গা থাকে না।

অবশ্য রাজধানীতে যেসব বাস কোম্পানির টিকিট কাউন্টার আছে, সেখানে পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। ছোট টেবিলে রাখার জায়গা থাকায় তাঁরা কয়েন নেন। তবে মাঝেমধ্যে আপত্তিও তোলেন।

দেশের বাজারে এখন ১, ২ ও ৫ টাকার ধাতব মুদ্রা বা কয়েনই বেশি চলে। এগুলোর আবার কাগুজে নোটও আছে। কিন্তু কয়েন লেনদেনে প্রায়ই বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। কয়েনের বদলে কাগুজে নোট ব্যবহারে আগ্রহ কিছুটা বেশি। অনেকে বলছেন, পকেটে বা টাকা রাখার ব্যাগে কয়েন রাখতে সমস্যা হয় বলেই আগ্রহ কমেছে। অনেকে আবার ব্যাংকগুলোকেও দায়ী করছেন।

একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক সামিনা জামান। কয়েন নিয়ে দুর্ভোগে পড়ার কথা জানালেন তিনি। তাঁর অভিযোগ, প্রায় সময়ই রিকশাচালকেরা ভাড়া হিসেবে কয়েন নিতে চান না। সামিনা বলেন, ‘এ জন্য প্রায়ই খুচরা ভাড়া নিয়ে ঝগড়া লেগে যায়। অনেকেই কয়েন নিতে চায় না। আবার ব্যাগে রাখতেও ঝামেলা। এখন তাই আমিও লেনদেনের সময় কয়েন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। দেব না, নেবও না।’

কয়েন জমে চা ও পান-সিগারেটের দোকানেও। তবে পান্থপথ সিগন্যালে চায়ের দোকানদার আমিনুল ইসলাম বলেন, ছোট ব্যবসা হওয়ায় তাঁদের বেশি কয়েন জমে না। যা জমে, সেগুলো ক্রেতাদেরই আবার ফেরত দেন। কিন্তু পাইকারি বিক্রেতা বা মহাজনদের কাছে কয়েন দিয়ে পণ্য কেনা কঠিন।

ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে মুদি দোকান চালান মাহবুব সরকার। তিনি বলেন, গত এক মাসে কয়েক হাজার টাকার কয়েন জমেছে তাঁর। কিন্তু একদিকে যেমন খদ্দের নিতে চায় না, অন্যদিকে কয়েন বদলে কাগুজে নোট দিতে ব্যাংকের কর্মকর্তাদেরও অনীহা আছে। মাহবুব বলেন, ‘আমার দোকানে এক, দুই ও পাঁচ টাকার অনেক জিনিস আছে। এগুলো বিক্রি করতে গিয়েই কয়েন জমে। কিন্তু ব্যাংকে বদলাতে গেলে সহজে নিতে চায় না।’

গ্রাহকদের কাছ থেকে তফসিলি ব্যাংকের কয়েন নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় প্রতিবছরই বিজ্ঞপ্তি ও নির্দেশনা দিয়ে থাকে। চলতি বছরের মার্চ মাসে এমনই একটি বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের নোট গ্রহণ, ছেঁড়া-ফাটা ও ময়লা নোটের বিনিময় মূল্য প্রদান এবং ধাতব মুদ্রা গ্রহণ ও বিতরণের বিষয়ে দেওয়া পূর্বের নির্দেশনার পুনরাবৃত্তি করেছে।

এতে বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংকের অনেক শাখা তাদের গ্রাহকদের ধাতব মুদ্রা এবং জনসাধারণের ছেঁড়া-ফাটা ও ময়লাযুক্ত নোটের বিনিময়মূল্য প্রদানে অনীহা প্রকাশ করছে, যা অনভিপ্রেত।’ এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে কঠোর নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

কিন্তু কেন ব্যাংকগুলো কয়েন নিতে চায় না? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কয়েন নেওয়ার ব্যাপারে গ্রাহকদের আগ্রহ কম। ধরুন কেউ ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা তুলছেন, তাঁকে যদি এক হাজার টাকাও কয়েনে নিতে বলি, তিনি রাজি হন না। যেহেতু গ্রাহকদের মধ্যে আমরা চালাতে পারি না, তাই নিতেও চাই না।’

একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা জানালেন ভল্টে জায়গা না থাকার কথা। প্রতিষ্ঠানের বিধিনিষেধের কারণে নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি তিনিও। তাঁর কথায়, ‘কয়েন ব্যাগে ভরে রাখতে হয়। এতে ভল্টের অনেক জায়গা চলে যায়। গ্রাহকদের দিয়েই কয়েন চালাতে হয়। কিন্তু গ্রাহকেরা না নিলে, আমরা এত কয়েন কোথায় রাখব?’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘প্রয়োজন ও চাহিদা—এ দুটির ওপর নির্ভর করবে এর সমাধান। চলে আসছে, সে জন্য এটি চলছে। আগে মাটির ব্যাংকে কয়েন জমানো হতো। এখন টাকা জমানোর আরও অনেক বিকল্প এসেছে। ব্যবহারকারী বা গ্রাহকের সুবিধা ও চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’